জীবনের প্রায় ৪০টা বছর পার করে এসে মনে হয়, এ জীবনে এমন কিছু লেখা পড়লাম,কিছু গান শুনলাম যা আমার এই এত বছরের জমে ওঠা বলা-না বলা কথা, হাসি-কান্না, ভাঙ্গা-গড়া, আলো- আঁধার সব কিছুকে মুহূর্তে ব্যক্ত করে দিল। নিজের অজান্তেই, নিজের সমস্ত আবেগ লাগামছাড়া, দুচোখ দিয়ে বয়ে গেল, কোনও আড়াল থাকলো না।
খুব বেশি বয়স নয় আমার তখন, বোধহয় কলেজে পড়ি, একটি গান অর্ঘ্য সেনের গলায় শুনলাম একদিন, “যদি মরমে লুকায়ে রবে, হৃদয়ে শুকায়ে যাবে/ কেন প্রাণভরা আশা দিলে গো” - সে
গান আমার জীবনের গান হয়ে যাবে সেদিন হয়ত ভাবিনি, কিন্তু বড় টান অনুভব করতাম, বারবার ফিরে ফিরে শুনতাম। শুধু ভাল লাগা নয়, তার থেকে বেশি কিছু, অনেক অনেক বেশি কিছু পাওয়া।
শান্তিনিকেতন প্রবন্ধাবলীতে একজায়গাতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - “ পৃথিবীতে আমাদের ভাগে যে সুখ পড়ে তাও কি একেবারে ঠিক হিসাবমত পড়ে, অনেক সময়েই কি আমরা গাঁঠের থেকে যা দাম দিয়েছি তার চেয়ে বেশি খরিদ করে ফেলি নে? কিন্তু কখন তো মনে করি নে আমি তার অযোগ্য। সবটুকু তো দিব্য অসংকোচে দখল করি দুঃখের বেলাতেই কি কেবল ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব মেলাতে হবে? ঠিক হিসাব মিলিয়ে কোন জিনিস যে আমরা পাইনে।” যে দুঃখকরকে রবীন্দ্রনাথ প্রণাম করতে বলেন, এ গান যেন সেই দুঃখকরকেই পাবার আকুতি - “যদি মধুর শান্তনাভরে তুমি না মুছাবে করে, কেন ভাসি নয়ন সলিলে গো…” কান্তকবি রজনীকান্ত রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন অনেকেই বলেন, কিন্তু তাঁর গানের এই আকুতি তা কেবলই তাঁর নিজের,তাঁর গানের সব থেকে বড় সম্পদ - তাঁর গানের বেদনা।
জীবন যত পরিণত হয়েছে এই গানটি আমি নতুন করে পেয়েছি, শুধু ‘উপলব্ধি করা’ বললে, সেই পাওয়ার স্বাদ বোঝানো যাবে না, সে পাওয়ায় কোনও প্রাচুর্যের আতিশয্য নেই, আছে নিঃস্বতার মুক্তি, দীনের আনন্দ।
আমার খুব প্রিয় গীতার একটি শ্লোক;-
“তস্মাৎ প্রণম্যে প্রানিধায় কায়াং
প্রসাদায়ে তাম আহমিস্মিদ্যাং
পিতেব পুত্রেস্য সখেব স্খ্যু
প্রিয় প্রিয়ায়ার্হাসি দেব সঢ়ূম “
এর সারমর্ম হল - “আজ তোমার সম্মুখে আমি সাষ্টাঙ্গে নত হয়েছি, তোমার ক্ষমা প্রার্থনা করতে। পিতা যেমন পুত্রকে, সখা যেমন সখাকে, প্রিয় যেমন প্রিয়কে ক্ষমা করে তুমিও আমায় সেভাবেই ক্ষমা কর।”
আর এ গানে রজনীকান্ত লিখেছেন -
“এতই আবেগ প্রভু
ব্যর্থ কি হইবে কভু
এ কান্ত ও চরণে সঁপিলে গো
যদি পাতকী না পায় গতি
কেন ত্রিভুবনপতি
পতিতপাবন নাম নিলে গো”