‘ভাষালিপি’র নবনীতা সেন বা নবনীতা সেনের ‘ভাষালিপি’

‘ভাষালিপি’র নবনীতা সেন বা নবনীতা সেনের ‘ভাষালিপি’

লেখকের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
---লিখেছেন : দেবার্চনা সরকার

এমন কিছু বই আছে যেগুলি মাথার পাশে নিয়ে শুলে বড়ো শান্তির ঘুম আসে। এমন কিছু বই আছে চরম বেদনার মূহুর্তেও পরম প্রাপ্তির সুখ দিতে পারে। একটা বহু কাঙ্খিত সবপেয়েছির জীবনকে আদ্যন্ত ভুল প্ৰমাণ করে দিতে পারে এমন কিছু কিছু বই আছে।
রবীন্দ্রনাথকে আমি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি , “ রূপে তোমায় ভোলাবোনা “ গাইতে গাইতে মা যখন অঝোর ধারায় কাঁদতো , সেই শিশুবয়েসে বুকের ভিতর হু হু করে উঠত, কি যেন বলতে চাইতাম, কিন্তু “কী বলব?”
“কী বলব?”, “কী বলব?” করতে করতে শিশুকাল কেটে গেল, কৈশোর কেটে গেল, মধ্য যৌবনে এসে একদিন হঠাৎ পড়লাম। ………….
“ মাঘী পূর্ণিমায়, চারিদিক ভরা কুয়াশায় , ঢেকে যায় আমার শরীর। কত মানুষের ভিড় রেখে যায়, পৃথিবীর কত কথা, গোপনে, আড়ালে। মাঝে মাঝে সে কথা , সে ব্যথা শব্দ করে ওঠে!
কে কাঁদে? কে পাতে কান?
‘দুঃখ তার দান’- তুমি, বলে চলে যাও পাশ দিয়ে। “ (আনন্দ নির্ঝর)
আমি তখন কলকাতা ছেড়ে দূরে থাকি, ‘আনন্দ নির্ঝর’ বইটি আমার হাতে এসেছিলো পরম আত্মীয়ের মতো।
“ দিদির বিয়ের সময় বাড়ি বিক্রি হল। কেটে ফেলা হল গাছগুলো। মা কেঁদে ছিলো খুব, বলেছিল - ওরা আমার সন্তানের মতো - আমায় ক্ষমা করো ভগবান।
ভগবান প্রতিদিন ক্ষমা করেন আমাদের - প্রতিদিন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলেন - আছ নাকি ঘরে?” (আনন্দ নির্ঝর)
আমাদের বাড়ির সামনের পলাশ গাছ দুটো কেটে দিলো, রাস্তা চওড়া হবে , পার্ক হবে, মরা গুঁড়ি দুটো ভাসিয়ে দিলো খালের জলে - আমি কাঁদতে পারিনি। মনে আছে আনন্দ নির্ঝর পড়ে কেঁদে ছিলাম অনেকক্ষণ…………বলেছিলাম ‘ঈশ্বর ক্ষমা, ক্ষমা। “
বয়েস বেড়েই চলে , মন শুধু থেমে থাকে , শিশুবয়েসের বিস্ময়, কৈশোর পার করে যৌবনেও অমলিন থেকে যায়। ……….এমন সময় হাতে পেলাম “সূর্যমুখী “
“ শেষ রাতে বাতি নিভে যায় , সলিতা ফুরায়।
ঐ মাঠ -ভরা তারা , ওরা ফুরাবে না?
ছোট ছোট বাতিগুলি ,চন্দনের
ফোঁটা যেন , আঁধার সাজায়। “

তারপর
“প্রতিদিন বেঁচে ওঠা - গাছ গুলি জানে।
চৈতন্য - শিহরে কাঁপে প্রতি টবে পাতা।
মালী এসে টবে টবে রোদ ঢেলে গেছে। “
আমি গাছে জল দিই , মাটি খুঁড়ে দিই , মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠি , ‘সূর্যমুখী “ বইটি আমার সুহৃদ।
আরো পরে মাথার পোকা যখন বেশ পাকাপাকি ভাবে নড়ে গেছে , আরো একটি বই আমাকে পুরো আপাদমস্তক কাঁপিয়ে দিল………” মানুষের মূর্তি “
“প্রতিদিন
আমার মা ঐ কাঠকুটো কুড়িয়ে জড়ো করেন উনুনের ধারে
তাঁর হাতের শাঁখা - চুরির শব্দ হয় টুন-টান
আমার বাবা দাঁড়িতে হাত বুলোন আর
গুনগুন করে যাত্রা-বইয়ের সংলাপ বলেন , আর
সমস্ত দিন ধরে একটানা মন্ত্রোচ্চারণের মতো
তিনি তাঁর সেলাইকল চালান
আমরা ভাইবোনেরা তাঁদের ঘিরে ঘিরে
একটু একটু করে বড়ো হতে থাকি ,প্রতিদিন ,একটু একটু করে
গহরের বাপজান
পুলিশ আর পলাতক পুত্রের জন্যে
সারাক্ষণই ভাবেন আমাদের গহরের বাপজান
বাবার সঙ্গে সমসাময়িক দিনকাল নিয়ে কথা বলেন , ধীরে
তাঁর রুক্ষ দাঁড়িতে হাত বুলোন আর বলেন -
আমাদের চারদিকেই শত্তুর
খরা, বন্যা ,জোতদার আর মহাজন
আমরা জীবনভোর ঝড়ো হাওয়া আর খিদের সঙ্গে লড়েছি
পুলিশের তো আছে একটা বগলসে বাঁধা রাইফেল
কিইবা তার ক্ষমতা। “

এইসব আশ্চর্য লেখা বারবার প্রকাশিত হয়েছে “ভাষালিপি” থেকে। আমার সামান্য জীবনের যৎসামান্য বইয়ের যে ভান্ডার এবং পাঠ-অভিজ্ঞতা তার অনেকটাই ভাষালিপির কারণে। আর ‘ভাষালিপি’র সঙ্গে আমার মূল যোগসূত্র রঞ্জনদা ( তাঁর কথা আর একদিন বলবো)। ভাষালিপির কর্ণধার নবনীতাদির সঙ্গে পরিচিতি ও রঞ্জনদার মাধ্যমেই, তবে সেভাবে কখনোই কথা হয়ে ওঠেনি। ২০১৮-এর ডিসেম্বরে শেষবার যখন দেখা হয় বলেছিলেন “তোমার সঙ্গে তো আলাপই হলো না, একবার এস গল্প হবে”.........গল্প হয়নি, যদিও এই মানুষটিকে জানার তার সাথে গল্প করার বড়ো লোভ ছিল আমার, এইসব অপূর্ব বই যার করা তাঁকে কাছ থেকে জানার চেনার ইচ্ছে ছিল ষোলআনা ।…… ২০১৯-এ আমার ছেলে ‘বাবুই’ হলো আর তারপরই লকডাউন। ২০২১ সেপ্টেম্বর , বাবুই সবে ২-য়ে পড়েছে, পুজোর সময়, রঞ্জনদা হঠাৎ খবর দিল নবনীতাদি নেই। তাঁর সঙ্গে তেমন যোগাযোগ আমার ছিল না যে শোকস্তব্ধ হয়ে যাবো, তবু সেদিন প্রিয়জন হারানোর এক তীক্ষ্ণ যন্ত্রনা টের পেয়ে ছিলাম।
আমার বিশ্বাস একজীবনে মানুষ অনেকবার জন্মায়…………… যতবার সে নিজেকে নতুন করে জানে, বোঝে। আমার এবং আমার মতো আরও অনেক পাঠকের নিজেকে জানার যে প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে তার সিকিভাগ পূর্ণ হতো না যদি না ভাষালিপির মতো এমন সৎ কোনো প্রচেষ্টা থাকতো। ভাষালিপির নবনীতা সেন আমার কাছে চিরকালের মতো এক মায়াবী স্বপ্ন হয়ে রয়ে গেলেন, যাঁর দিকে আমি অগাধ শ্রদ্ধায়, মুগদ্ধতায় তাকিয়ে থাকতে তো পারি, কিন্তু তাকে ছুঁতে পারি না।
আরো পরে তাঁর লেখা “হুস হুস” তাঁর নিজের বই, নিজের কথা পড়তে গিয়ে দেখলাম কি সহজ ভাষা, অনাড়ম্বড় অথচ সাবলীল, বইটি একবারেই পড়ে শেষ করেছি, শেষ করে মনে হলো যেন কতকালের এক বন্ধুর সাথে আলাপ হলো, হয়তো যে আলাপ আমাদের অনেকদিন থেকে হবার ছিল, মনে হল নাড়ীর টান , রক্তের টান এ-ছাড়াও মানুষে মানুষে আরো কিছু যোগাযোগ স্থায়ী - মনের টান , বোধের টান অনুভবের টান।
বাবুই এ - বার ৩-এ পড়ল, ও জানে গাছ , পাখী ,কুকুর,বেড়াল ,শামুক সবাই ওর বন্ধু , ও জানে বৃষ্টি হলে আমাদের বাগানটা রেইন ফরেস্ট হয়ে যায় আর উঠোনটা আমাজন নদী, ও জানে পাহাড়ের গায়ে, জলের উপর মেঘের ছায়া পড়ে। ওকে আমি উত্তরাধিকারে দিতে চাই “আনন্দ নির্ঝর”, “সূর্যমুখী “, “হুস হুস “ আর “যে জীবন শালিখের, দোয়েলের “ কিন্ত তারপর ভয় হয় - নবনীতাদির মতো মানুষেরা ধীরে ধীরে কমে আসছেন আমাদের চারপাশ থেকে, এখন শুধুই স্তাবকতা, আত্মপ্রচার আর বিজ্ঞাপন, ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে চলেছে জীবন। তাহলে বাবুই-কে যে আরেকটা পৃথিবীর কথা বলেছি আমি ‘যেখানে ঈশ্বরের মতো চাঁদ ওঠে” , যেখানে “ মধু ঝড়ে পড়েছে হাওয়ায়” - সেই মায়ার জগৎ, ও কি কখনো চিনবেনা?

Boier Haat™   |   © All rights reserved 2024.