বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : অনিঃশেষ ভালোবাসার নাম

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : অনিঃশেষ ভালোবাসার নাম

লেখকের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : অনিঃশেষ ভালোবাসার নাম
লিখেছেন: কাজী হাসানুর
__________________________________________
কবি যত শক্তিমানই হোন, তাঁকে ভাল মানুষও হতে হবে। যিনি বলতেন এ কথা তাঁর কাঁধে সারাক্ষণ একটা ঝোলা থাকতো। আর ঝোলার ভেতরে থাকতো কবিতার বই। আর তাতে থাকতো মন্ত্রের মতো সব লাইন। যা তখন কবিতা পাগল তরুণদের মুখে মুখে ফিরতো। হ্যাঁ, এই কবির নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এক অনিঃশেষ ভালোবাসার নাম।
তিনি বলতেন এভাবেই -
১। ‘মাটি তো আগুনের মতো হবেই/ যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো/ যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও/ তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।/ যে মানুষ গান গাইতে জানে না/ যখন প্রলয় আসে, সে বোবা অন্ধ হয়ে যায়।’
২। 'আসলে মুখোশ মোটেই বাইরের নয়। বরং ভিতরে/ যাকে আমরা সত্যিকারের মুখ ভাবি/ তেমন কিছুই মানুষের নেই।’ ক্ষুধার্ত মানুষ রাতের আকাশে পায় ‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ’। মানুষকে বলেন, ‘তোমার কাজ/ আগুনকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয়/ আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা’।
জীবন যাপনে নিজের আদর্শ, স্বাধীনতা ও সততার প্রতি সতত দায়বদ্ধ যিনি । অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই ও প্রতিবাদের বিরল সাহস আর মানুষের প্রতি অনিঃশেষ ভালবাসার আর এক নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। যাঁর উচ্চারণ ছিল -
যদি আমি সমস্ত জীবন ধ’রে
একটা বীজ মাটিতে পুঁততাম
একটা গাছ জন্মাতে পারতাম
যেই গাছ ফুল হয়, ছায়া দেয়
যার ফুলে প্রজাপতি আসে, যার ফলে পাখিদের
ক্ষুধা মেটে
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি মাটিকে জানতাম !
আবার কখনো দেশের প্রতি গভীর মমতায় বলে ওঠেন - ‘তোর কি কোনো তুলনা হয়?/ তুই ঘুমের মধ্যে জলভরা মেঘ, জাগরণে জন্মভূমির মাটি।’
অথচ যাঁর শুধু আক্ষেপ ছিল ‘আমার জন্মভূমিকে এখন আমি স্বদেশ বলতে পারি না।’ চল্লিশের দশকে অনেক কবি-লেখকের সঙ্গেই ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা। তাঁদের মধ্যে রাম বসু, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের মতো কবি, আবার অমিয়ভূষণ মজুমদারের মতো গদ্যকার, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো গায়ক। বলতেন, ‘এদের সবাইকে নিয়ে আমার যে নিজস্ব পৃথিবী তার পায়ের নীচে কিছু শক্ত মাটি রয়ে গেছে, সেখানেই আমার অথবা আমাদের জোর।’
যে মানুষটার সাথে দেখা হলেই জীবনানন্দ বলতেন - 'একটা ভাল বাড়ি দেখে দিতে পারেন?' অথচ এ মানুষটিও অভাবী ছিলেন। বারবার কর্মহীন হয়েছেন। নানান কাজ করেছেন। প্রতিনিয়ত অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে তাঁকে । তবু সরকারি বৃত্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতাকে তীব্র শ্লেষ করে লিখেছেন - ‘রাজা আসে যায়/ রাজা বদলায়।.... ’
যাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর। বলতেন, কবি যত শক্তিমানই হোন, তাঁকে ভাল মানুষও হতে হবে। বলতেন, প্যাশন, ভিশন, মিশন, এই তিনটের কোনও একটাও কোনও কবির কবিতায় প্রবল ভাবে থাকলে সে কবিতা পাঠককে টানবেই। তাঁর ভাষায়, ‘আধুনিক সভ্যতার কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি, কিন্তু আমাদের আত্মাকে হারিয়েছি। জীবনের শেষ দিকে লিখেছিলেন, ‘প্রেমের গান গাইতে গাইতে হঠাৎ গলা থেকে একঝলক রক্ত উঠে আসে। সময়, স্বদেশ, মনুষ্যত্ব, কোথাও যদি একসূত্রে গাঁথা যেত ?' বলতেন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নয়, প্রশ্ন করাটাই হয়তো কবির ধর্ম।
আধুনিক বাংলা কবিতার এক মাইলফলকের নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ঢাকা বিক্রমপুরের অভিজাত সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের সাথে মিলিত হয়ে যেন বেশি স্বস্তি বােধ করতেন। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি বাল্যকাল থেকেই গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছিলেন। তিনি নিজের চোখে দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দেখেছেন দেশ ভাগ ও মন্বন্তরের করাল ছায়া। দেখেছেন দেশের সমাজজীবনে ও অর্থনৈতিক জীবনে তার নির্মম প্রতিক্রিয়া। এসেছেন বিচিত্র মানুষের সান্নিধ্যে যা তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাকে করেছে সমৃদ্ধ। তেভাগা আন্দোলনের চাষিদের ওপর জোরদার ও পুলিশের সম্মিলিত অত্যাচার দেখেছেন। গুলিতে চাষিদের মৃত্যু দেখেছেন। মানুষের উপর এমন অমানবিক পাশবিকতা দেখে তাঁর কবিমন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে বারেবারে। তার প্রকাশ প্রতিনিয়ত আমরা প্রতিফলিত হতে দেখেছি তাঁর কবিতায়। যদিও কবি তার কবিতার সম্ভার নিয়ে যেভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন ততটা তিনি পারেন নি। অবশ্য এতে তাঁর ক্ষোভ ছিল না একটুও। তিনি এজন্য দায়ী করেছেন স্বার্থপর রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থাকে। এজন্যে সাধারণ মানুষকে তিনি বিন্দুমাত্র দোষ দেন নি। তিনি ছিলেন ভীষণ রকম বাস্তববাদী কবি। বাস্তব জীবনে প্রতি আকর্ষণ তাঁকে কল্পনার জগৎ থেকে নামিয়ে এনেছে মাটির কাছে। মানুষের যাপিত জীবনের নানা বাধাবিপত্তি কবিকে প্রতিনিয়ত ছিন্নভিন্ন করেছে। যে ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর অসংখ্য কবিতায়। তাইতো কবি হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষের ব্যথা বেদনার রূপকার। গড়ে তোলেন এক আশার পৃথিবী। কবি বেহুলা কবিতায় বলেন- সে জাগবে। জাগবেই। আমি তাকে কোলে নিয়ে বসে আছি রক্ত-পুঁজে মাখামাখি রাত্রিভেলায় ভাসিয়ে। সাধারণ মানুষের অদ্ভুত বেঁচে থাকা দেখে তাঁর কবিতায় প্রেমের প্রকাশভঙ্গী যায় বদলে। কবি বলেন - মালটানা গাড়ির শব্দ, কুকুরের কান্না / তোমার রাতের ঘুমের পাশে আমার রাত্রি জাগরণ /অদ্ভুত এই পৃথিবীতে জীবনধারণ। কোনো রকম ভণিতা না করেই যে কবি মননের আশাবাদকে স্পষ্ট করেন তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কানাকানি, দীর্ঘশ্বাস আর সতর্কতাকে এড়িয়ে পাখির গান এগিয়েই চলেছে। অদ্ভুত মিষ্টি ওর সেই ডাক যেন আহ্বান প্রিয়াকে - এমন কথা যিনি বলেন তাঁরই তো নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমাদের কাছে অনিঃশেষ ভালোবাসার এক নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য কিছু কাব্যগ্রন্থ :
গ্রহচ্যুত (১৯৪৪), রাণুর জন্য (১৯৫১),
লখিন্দর (১৯৫৬), ভিসা অফিসের সামনে (১৯৬৭),
মহাদেবের দুয়ার (১৯৬৭), মানুষের মুখ(১৯৬৯), ভিয়েতনাম :ভারতবর্ষ (১৯৭৪),
আমার যজ্ঞের ঘোড়া (১৯৮৫)

Boier Haat™   |   © All rights reserved 2024.