ঘর (ছোট গল্প) জনা মজুমদার

ঘর (ছোট গল্প) জনা মজুমদার

খোশগল্প
এত দিন পর কাজরীর সাথে দেখা হবে ভাবতেও পারেনি অসিত। বাস থেকে নেমেই চোখটা আটকে গেল। টিপটিপে বৃষ্টিতে জলেকাদায় মাখা কলেজস্ট্রীট। পিছনে পুরোনো বইএর দোকানের সারি। বাসস্ট্যান্ডে কাজরী দাঁড়িয়ে। পরনে কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি। এলো খোঁপা ঘাড়ের কাছে থমকে আছে। কপালে একটা বড় মেরুন রঙের টিপ। আশ্চর্য এটাই ছিলো ওদের দেখা করার জায়গা। বাইশ বছর পরেও কাজরীকে সেখানেই আবার দেখতে পেল অসিত!
যেন কালকেই দেখা হয়েছে, তেমন স্বাভাবিক ভাবেই কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল- তুমি এখানে কাজরী! বই কিনতে এসেছ বুঝি?
বোধহয় গভীর ভাবে কিছু
ভাবছিল। চমকে উঠে একটু অচেনা চোখে চাইল। তারপর অসিতকে চিনতে পেরে সেই আগের মত আলো আলো হয়ে উঠল মুখটা।
- অসিতদা!
- যাক চিনতে পেরেছ তাহলে!
- কি যে বল! তোমাকে চিনব না! কেমন আছ?
- চলে যাচ্ছে।- কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছিল না। চুপ করে চেয়ে রইল অসিত। আগেও কাজরীর গড়নটা ছিপছিপে ছিল। এখন যেন আরও একটু রোগা হয়েছে। বাইশ তেইশের সেই লাবণ্য হয়তো কমেছে। কিন্তু ওকে এক লহমায় চিনিয়ে দেয় ওর গভীর কালো দুটো চোখ। কাজরী সুন্দরী কিনা অসিত কখনো ভাবেনি। কিন্তু ওই চোখদুটো ওকে পাগল করেছিল।
অসিতের তাকানোয় বোধহয় কাজরীর অস্বস্তি হচ্ছিল। তবে আগের মত জিজ্ঞেস করলনা - কি দেখছ অমন করে?
বরং সহজ ভাবে বলল- এখন কি তুমি কলকাতায়? চাকরি নিয়ে নাগপুরে না কোথায় যেন চলে গিয়েছিলে? বাড়িশুদ্ধ সবাইকে নিয়ে হঠাৎ চলে গেলে!
- হ্যা তখন কলকাতা থেকে দূরে যেতেই মন চাইছিল। এখন আবার কলকাতায়। বছর তিনেক আগে সেই ওষুধ কোম্পানিটা উঠে গেল। আমারও ফিরতে ইচ্ছে করছিল কলকাতায়।
-সে কি! এখন তাহলে কি করছ?
- ঐ টুকটাক চেষ্টা করছি। ভেবনা। সামলে নেব। তোমার খবর কি বল।
- আমার আবার খবর!- কাজরী লাজুক ভাবে হাসে।
- সে কি পুত্রকন্যা নিয়ে মহা দাপটে ঘরকন্না করছ নিশ্চয়।পতি দেবতার কিসের যেন ব্যবসা ছিল।- বলেই একটু লজ্জা পেল অসিত।এতোদিন পরে দেখা। একটু ভদ্রভাবে কথা তো বলা যেতে পারে! নিজের অস্বস্তি কাটাতে বলল- চল‌ দিলখুশে গিয়ে বসি। খিদেও পেয়েছে খুব।
ভীড় রাস্তা পার হয়ে ওপারে যেতে গিয়ে অনেক দিনের স্মৃতি মনকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সেই দেখা হওয়ার দিনগুলোতে এমনি করেই রাস্তা পার হয়ে ওরা দিলখুশে যেত।
ঢুকেই কাজরী বলল - ইস্ কি ভীড়!
সত্যি অল্পবয়সী ছেলে মেয়েতে গিজগিজ করছে সামনের হলটা। বরাত জোরে একটা ফাঁকা কেবিনে জায়গা পেল ওরা। অপরিসর কেবিনে মুখোমুখি বসল দুজনে। বেয়ারা এসে অর্ডার নিয়ে গেল।
অসিত বলল - তোমার কি খবর বল। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে?
কাজরী হালকা হেসে বলল - একটাই মেয়ে। গ্র্যাজুয়েশন করছে।
অসিত মনে মনে ভাবছিল, সব কিছু আগের মত মনে হলেও আসলে কোনো কিছুই আগের মত নেই। একটু পরেই কাজরী ফিরে যাবে ওর নিজের বৃত্তে যেখানে অসিতের কোনো অস্তিত্বই নেই। আর অসিত ফিরবে তার ফাঁকা বাড়িতে। তবু অনেক দিনের না পাওয়া এক ভালো লাগা ছুঁয়ে যাচ্ছে অসিতকে।
- নিজের কথা কিছু বলছ না যে! বিয়ে করেছ?
একটু থমকে গেল অসিত। তারপর বলল - করেছি। দুই ছেলে মেয়ে আর বৌ নিয়ে ভরাট সঙসার। তোমাকে না পেলে যেমন বাউন্ডুলে হয়ে যাব বলে ভয় দেখাতাম, তেমন কিছুই হইনি। বরং অনেক দেখেশুনে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করেছি। বৌকে নিয়ে সিনেমা থিয়েটারে যাই। ছেলে মেয়ে দুটোও বড় হয়ে উঠছে।
- ভালোই তো!- কাজরী অস্ফুট গলায় বলল। ওর মুখটা বেশ ম্লান দেখাচ্ছে! অসিতের সুখী জীবনের কথায় কি একটু মুষড়ে পড়ল? গড়গড়িয়ে এতো গুলো মিথ্যে বলে প্লেটের ধূমায়িত ফিশফ্রাইতে নুন গোলমরিচ ছেটাত ব্যস্ত হলো অসিত। কাজরীকে ও বলতে চায়না সেই প্রত্যাখানের পর বিয়ে করার ইচ্ছেটাই তার চলে গেছে। বাইশ বছর আগের সেই অপমানটা ফেরত দেওয়ার জন্য অসিতের মনে বোধহয় একটা প্ররোচনা কাজ করছে। ওর অনেক কাকুতি মিনতি উপেক্ষা করে সেদিন বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল কাজরী। এই দিলখুশের কেবিনে বসেই কাজরীর হাতদুটো টেনে নিয়ে অসিত বলেছিল - চল লুকিয়ে রেজিস্ট্রেশনটা সেরে ফেলি। তারপর কিছুদিন না হয় তপনদাদের নিমতার বাড়িতে দুজনে থাকব। তপনদার সাথে কথা হয়ে গেছে।
কাজরী আকুল হয়ে কাঁদছিল আর বলছিল - আমি পারবো না। সবাইকে লুকিয়ে এত কিছু করতে আমি পারবো না।
অসিত বলেছিল - চল আজ ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে নোটিশটা তো দিয়ে আসি।আর লুকোতে তো আমি চাইছি না। আমাদের এতোদিনের সম্পর্কের একটা পরিণতি দিতে চাইছি- এতে অন্যায় কোথায়? তোমার বাবা যদি জাতপাতের মতো একটা মধ্যযুগীয় ইস্যুকে এত বড়ো করে না তুলতেন , তাহলে এ বিয়েতে বাধাটা কোথায়? মাথা উঁচু করে বিয়ে করতে পারি আমরা। তোমার বাবার মত জোগাড় কর। যদি তুমি চাও আমি আবার গিয়ে মহাদেব কাকুর সঙ্গে কথা বলব।
- না প্লীজ না। বারে বারে জাতের কথা তুলে তোমাকে অপমান করে বাবা। একটুও ভালো লাগে না আমার।
- তাহলে কি করব আমরা?- অসিত অধৈর্য গলায় জিজ্ঞেস করেছিল।
কাজরী বলেছিল - বাবার কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় দেখছিনা।
- তুমি কিন্তু একটা প্রচন্ড অন্যায়কে মেনে নিচ্ছ কাজরী। তোমার বাবার একটা অযৌক্তিক ধারনার জন্য আমাদের এতদিনের সম্পর্কটাকে ভেঙে দিচ্ছ!
জাতের ব্যাপারটা আমার হাতে নেই। কিন্তু বিয়ের পর তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার। বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউ দিয়েছি। চাকরি আমি পেয়ে যাব।
- তা জানি। তবু - রাগ কোরোনা। বাবার এতো আপত্তিকে উপেক্ষা করতে আমার কেমন ভয় করছে- আবার তোমাকে ছাড়াও ভাবতে পারছিনা। তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না!
শেষ অবধি একটা হেরে যাওয়া মানুষের মতো সেদিন বাড়ি ঢুকতে হয়েছিল অসিতকে। তার কয়েক দিনের মধ্যেই নাগপুরের চাকরির এ্যাপয়েনমেন্ট লেটারটা এসে যেতেই আর দেরি করেনি সে। সামনে বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। একসপ্তাহের জন্য নাগপুরে গিয়ে জয়েন করে অসিত বাড়ি ঠিক করে এল। ফিরে এসে শুনল পাড়ায় মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করা শুরু করে দিয়েছেন কাজরীর বাবা। কাজরীর বিয়ের আগেই মা আর দুই বোনকে নিয়ে জিনিসপত্র সমেত নাগপুরে পৌঁছে গিয়েছিল অসিত। অন্তত কাজরী আর কারো সাথে জোড় বেঁধে বধূবেশে চলেছে এই দৃশ্যটা দেখতে চায়নি সে। আর চাইছিল না কোনোদিন কাজরীর বাবা মহাদেব কাকার মুখোমুখি হতে। ওদের সম্পর্কের কথা জানার পর ছোটবেলা থেকে চেনা মহাদেবকাকা হঠাৎ কেমন বদলে গেলেন। ছোট জাত শব্দটা যেন চাবুকের মতো পিঠে আছড়ে পড়লো। অথচ এই মহাদেবকাকা বাবার সঙ্গে গল্প করতে করতে অফিস যেতেন। বাবা হঠাৎ এ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ার পর সব কাজে অসিতের পাশে ছিলেন। আবার সহজ ভাবে বলতে পারতেন - কাজরীকে একটু অঙ্কটা দেখিয়ে দিস তো অসিত। ফেল না করে বসে!
সেই মহাদেবকাকা কেমন অনায়াসে অসিতকে বলতে পেরেছিলেন - এসব ভাবনা মাথাতেও আনিসনা। শূদ্র হয়ে ব্রাহ্মণকন্যাকে বিয়ে করা কত বড় পাপ তা জানিস?তোর সাথে বিশ্বাস করে কাজরীকে মিশতে দেওয়াই ভুল হয়েছে আমার।
হঠাৎ খেয়াল হলো কাজরী অনেকক্ষণ একদম চুপচাপ। পাশের কেবিন থেকে কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। সাথে ছুরি কাঁটার শব্দ। অসিত কাজরীর দিকে তাকাল। এক ঝলক চোখাচোখি। কথা শুরু করার জন্য অসিত বলল - মেয়ের নাম কি রেখেছ? কিসে অনার্স নিল?
- ওর নাম কাবেরি। পড়াশোনায় আমার মতোই সাধারণ। অনার্স নেয়নি। হায়ার সেকেন্ডারির সময় থেকে কোচিং এর এক টিউটরের সাথে প্রেম করছে। ছেলেটা ভালো চাকরি পেয়েছে। ভাবছি এই ডিসেম্বরে বিয়ে দিয়ে দেব।
- এত তাড়াতাড়ি!- অসিত একটু অবাক হয়।
- শুভ কাজ তাড়াতাড়ি হওয়া ভালো। তাছাড়া সাবালিকা তো হয়েই গেছে।
- জাত পাত সব ঠিক আছে তো?
- ছেলে খ্রীষ্টান।- অসিতের বিদ্রূপকে উপেক্ষা করে কাজরী বলে। - তখন বুঝিনি ,আজ বুঝি - মানুষকে নিজের মতো করে বাঁচতে দেওয়াই সবচেয়ে জরুরি।
তুমি কি করছ বললে নাতো অসিতদা।
- ঐ যে তুমি যে কথা বললে তারই চেষ্টা করছি। নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা। এক বন্ধুর সঙ্গে পাবলিকেশন হাউস খুলেছি। কয়েকটা টাইটেলও বার করেছি। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে কলেজস্ট্রীট অঞ্চলে একটা ঘরের দরকার। এখানে বইগুলো স্টক করতে না পারলে -
- লাগবে ঘর? সত্যি লাগবে?- কাজরী আগ্রহী গলায় শুধায়।
- এমন ভাবে বলছ যেন চাইলেই পাওয়া যাবে! কলেজ স্ট্রীটে একটা ঘর পাওয়া কত কঠিন কোন ধারণা আছে? কত সেলামি লাগবে জান?
- আমি জোগাড় করে দেব অসিতদা। সত্যি দেব। টাকার জন্য ভেবনা। তুমি যা পারবে তাই দেবে।
অসিত অবাক হয়ে বলল- তোমার হাতে সত্যি ঘর আছে কাজরী? দেখাতে পারবে আমাকে?
- পারব। এখনি।
কোন রকমে ফিশফ্রাই আর চা শেষ করল কাজরী। -চল অসিতদা দিনে দিনে দেখাই ভালো।
অলিগলির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললো কাজরী। কার ঘর- কি ব্যাপার - কোন কথার জবাব পেলনা অসিত। শুধু উৎসুক কন্ঠে বলে চলেছে - আগে একবার দেখ। তোমার পছন্দ হলে সব কথা হবে।
নবীন কুন্ডু লেনের একটা প্লাস্টারখসা বাড়ির সামনে দাঁড়াল কাজরী। খোলা দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে ডাকল - বীরুদা -। দু তিন বার ডাকার পর এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক কোনের ঘরে থেকে বেরিয়ে এলেন।
কাজরী বলল- বীরুদা আপনার কাছে তো চাবি আছে। এই ঘরটা একবার খুলে দিন প্লীজ। আমি আজ চাবি নিয়ে বেরোতে ভুলে গেছি।
কাজ করতে করতে উঠে আসতে হয়েছে বলে ভদ্রলোক বেশ বিরক্ত। - এই নিয়ে কতজন তো দেখল। -নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে ভদ্রলোক ওপাশের একটা বন্ধ ঘরের শিকলে লাগানো তালায় চাবি ঘোরান। দরজার চারদিকের কাঠামোটা বাদ দিয়ে প্রায় সবটাই ভাঙাচোরা,উইতে খাওয়া। দরজাটা খুলে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যান ভদ্রলোক। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। কাজরী অনুযোগ করে - ইলেকট্রিক লাইনটা কেটে দিয়েছে। দাঁড়াও ওদিকের জানলাটা খুলি।
জানলার ওদিকে উঠোন, চৌবাচ্চা। তার ওপাশে আরেকটা প্লাস্টারখসা বাড়ি। আবছা আলোয় দেখা গেল ঘরের দেয়ালেও লোনা ধরেছে। একটা স্যাতস্যাতে গন্ধ।
- চল বেরোই। - অসিত বলল।।
- দেখ এদিকে চেয়ার টেবিল আলমারি সবই আছে। ব্যবহার হয় না। পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে।
অসিত চেয়ে দেখল ঘরের এককোণে জরাজীর্ণ কিছু আসবাবপত্র রাখা।
- ঠিক আছে। এবার বন্ধ কর ঘরটা । নিজেই এগিয়ে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করল। নড়বড়ে পাল্লায় ছিটকিনি লাগানো কঠিন।
কাজরীর বীরুদা এসে আবার তালা লাগিয়ে দিলেন। তারপরে একটা টাইপ করা চিঠি কাজরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন- কর্পোরেশনের নোটিশ। অনেক বছর ট্যাক্স দেওয়া হয়নি।
- বাড়িওয়ালাকে বলেছেন?
-আমি একা বললে হবে?
-ঠিক আছে। আসব একদিন।চল অসিতদা।
- কর্পোরেশনের লোক এসে ঝামেলা করলে কিন্তু ঘর রাখা দায় হবে।- বীরুদা চাপা গলায় বলেন।
- সেই তো। শিগগিরই আসব একদিন।- বেরোতে বেরোতে কাজরী বলে। তারপরেই অসিতের দিকে চেয়ে বলে - ঘরটা কেমন লাগলো? একেবারে পাবলিকেশন পাড়া এটা। অসুবিধা হলে সেলামী লাগবেনা। মাসে মাসে ভাড়া দিলেই হবে।
অসিত বলল - কাজরী,এখন অবধি আমি জানিনা ঘরটা কার। একটু খুলে বলবে আমায়?
একটু হাসার চেষ্টা করে কাজরী। বলে - তোমার কাছে লুকোবার তো কিছু নেই। ঘরটা ছিল আমার বরের। বাঙলা ব্যকরণ, ইঙরেজী গ্রামার,ম্যাপ বই, সহায়ক বই - এসব পাবলিশ করত। জেলায় জেলায় সাপ্লাই দিত। বেশ চলত একসময়। আমাদের বেশী সময় দিতে পারতনা। কিন্তু বাড়িতে অভাব ছিল না।
- তারপর? কি হলো সেই ব্যবসার?
- সবই আমার কপাল! পাবলিকেশনের কাজে পুরুলিয়া যাবে বলে বেরিয়েছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ব্রিফকেসটা এখানেই রেখেছিল। জানিনা কোনো কাজ ছিল কিনা। তবে পুরুলিয়ায় যায়নি। যার কাছে যাওয়ার কথা ছিল, তার কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি। কিন্তু কোথায় যে গেল! কেউ কি শত্রুতা করে কিছু করল! কত খুঁজেছি! কতো থানা পুলিশ হাসপাতাল মর্গ! দশ বছর ধরে কোন হদিস পেলাম না। কর্পূরের মতো উবে গেল মানুষটা।
বর্ষার বিষণ্ণ সন্ধ্যা। কাজরীর চোখ জুড়ে একাকীত্ব। জিজ্ঞেস করা উচিত নয়। তবু অসিত শুধোল - অন্য কোথাও চলে যাননি তো? মানে দূরের কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর কাছে?
- তেমন কেউ ছিল বলে তো জানি না। অনেকেই জিজ্ঞেস করে কোনো মহিলা ঘটিত ব্যাপার ছিল কিনা। মানুষের মনের খবর কি করে জানব বল!
কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা অসিত। তবু বলে -দেখ হয়ত কখনো ফিরে আসবেন। তোমাদের চলছে কিভাবে?
- খুব কষ্ট করে। সেলাই শিখিয়ে, দোকানে ম্যাক্সি, নাইটি সাপ্লাই দিয়ে কোনো রকমে চালাচ্ছি। ওর জমানো টাকা যেটুকু ছিল প্রায় শেষ
হয়ে এসেছে। এই ঘরটা ভাড়া দিতে পারলে তবু খানিকটা নিশ্চিন্ত হতে পারি। বললে নাতো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা।
কাজরীর মরীয়া ভাবটা দেখে কষ্ট হয় অসিতের। আবার ওর পার্টনার বন্ধু দীপ্তর এরকম একটা ঘর পছন্দ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবু বলল- দেখি একবার আমার পার্টনারের সঙ্গে কথা বলে। ও একবার ঘরটা দেখুক।
ওর এড়িয়ে যাওয়া ভাবটা লক্ষ করে ম্লান হাসলো কাজরী।বললো - থাক।অপছন্দ হলে আমার মুখ চেয়ে নিতে হবে না।
পুজো এসে গেছে। কলেজ স্ট্রীটে ঝকঝকে আলো। বই পাড়ায় ব্যস্ততা। কাজরী শূণ্য চোখে সেদিকে চেয়ে আছে। যেন চারপাশের এই জীবন প্রবাহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই ।
অসিত বলল - ভাবছি বন্ধুকে নিয়ে আসার আগে আমি একাই একবার আসি। তোমার মোবাইল নাম্বারটা দাও। তোমাকে ডেকে নেব। দেখিনা দুজনে মিলে চেষ্টা করে ঘরটাকে ঠিক করা যায় কিনা। মিস্ত্রী দিয়ে দেয়ালটাকে চেঁচে ঠিক করাতে হবে। তারপর ভালো করে রঙ করিয়ে তাক বসিয়ে ঘরটাকে পুরো ঝকঝকে করে তুলব। ফার্নিচারগুলো পালিশ করিয়ে নেব।
- হ্যা ইলেকট্রিক কানেকশনটা আবার আনতে হবে।
- দরজা জানালার পাল্লাগুলো বদলানো দরকার।
- জানলার শিকগুলো সরিয়ে সুন্দর গ্রীল বসিয়ে দিলে হয়।
দুজনে মিলে ঘরের আলোচনায় মশগুল হয়ে যায়। একদিন দুজনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল। সে ঘর বাঁধতে পারেনি। কিন্তু এই কাজের ঘরের স্বপ্নটাও তো দেখতে মন্দ লাগছে না। স্বপ্নের জাল বোনাটাই বুঝি মানুষের নেশা।

Boier Haat   |   © All rights reserved 2023.