জহর সেনমজুমদার : এক ভিন্নতর অন্ধকারে যাত্রা

জহর সেনমজুমদার : এক ভিন্নতর অন্ধকারে যাত্রা

লেখকের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
জহর সেনমজুমদার : এক ভিন্নতর অন্ধকারে যাত্রা
লিখেছেন: কাজী হাসানুর

কবি জহর। বন্ধু জহর। চুপ থাকবো ভেবেছিলাম।
তবে চুপ থাকতে দিলো না সেই 'অন্ধকার'। আজ যে অন্ধকারে একজন ব্যর্থ সন্ন্যাসী বসে আছে। যে অন্ধকারে ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছি আমরা । একসাথে বেড়ে ওঠা সময়ের এই কবিকে ইতোমধ্যেই প্রজ্ঞা, ভাবনা, চিন্তন, মগ্ন-মগ্নতা থেকে জাত বাংলা শব্দভাণ্ডারের বিবিধ শব্দে প্রিয়জনেরা ভূষিত করেই ফেলেছেন। কবির জীবদ্দশায় এ হেন পাওনা সত্যি বড় পাওনা।
কবি জহর সেনমজুমদার এক তন্ময় কবি। বাংলা কাব্য জগতে বর্তমানে বহু সম্মানে সম্মানিত। বাংলাদেশের কাগজ প্রকাশনা ২০১৭ তে কবির শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশ করে কবিকে সম্মানিত করেছেন।
আজ একটু অতীতে যেতে হবে ১৯৯৬ জানুয়ারি। জহর তখন আজকের মতো প্রথিতযশা কবি জহর সেনমজুমদার হয়ে ওঠে নি। "সংযোজন পত্রিকা" র জানুয়ারি সংখ্যায় আমাকে একটা নিবন্ধ লিখতে বলা হয়েছিল "জহর সেনমজুমদারের কবিতার মনন ও মানসিকতা" শিরোনামে। সেদিন উক্ত নিবন্ধে লিখেছিলাম - জহর মনে হয় তাঁর সমসাময়িক কবিদের মতো স্বপ্নচারিতা, শূন্যতাবোধ, বিষাদ, নিসর্গপ্রেম ইত্যাদি বিসর্জন দিয়ে কবিতায় এনেছেন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সমস্ত বিষয়ের মধ্যে এক মৌল অভিন্নতার নতুন ভাষ্য । যার ফলে যুক্তি বুদ্ধি হৃদয়াবেগকে ছাড়িয়ে যায় এক গূঢ় অনুভব। উন্মোচিত হয় এক ভিন্নতর জগৎ। এক ভিন্নতর ভাবনা।
কবিতায় বাস্তব পরাবাস্তব থেকে পুনরায় বাস্তব এই ঘূর্ণনপথেই জহরের পরিক্রমা। তাই তাঁর কবিতার শব্দাবলীর জন্ম অনুভবে। কল্পনায় তাদের পুষ্টি।পাশাপাশি তাঁর কবিতায় উঠে আসে অন্তর্লীন কিছু অভিজ্ঞতার চিত্র। যেমন -
১। সিঁদুর মাখা আমের গুটি
২। মরা হেলে সাপের জ্যোৎস্না বাজানো
৩। খরগোসের আগুনে ঝাঁপ
৪। আকাশের শাদা খোলস
৫। শ্বাসনালীতে ঠোকর দেওয়া ইত্যাদি

আজ দীর্ঘ দু'যুগ পর আবার জহরের কবিতার মুখোমুখি আমি। হাতে এলো 'ক্রৌঞ্চদ্বীপ' পত্রিকার জহর সেনমজুমদার সংখ্যা। চাপা একটা আনন্দেরও মুখোমুখি আমি এই প্রৌঢ়ত্বে। সেখানে পড়লাম 'অন্ধকার' শিরোনামে এই কবিতাটি। যেটি এই লেখার নিচে দিলাম। মনে হলো, তবে কি যুগের পরিবর্তনের সাথে জহর পাল্টিয়েছে। না, এক অন্ধকার থেকে আর এক ভিন্নতর অন্ধকার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে জহর। যে অন্ধকারে এক ব্যর্থ সন্ন্যাসী বসে আছে এবং তাঁকে রক্ষা করার চরম আকুতি। এ যেন এক অন্য জহর। আজ আমি আবারও এক অন্য ধ্যানতন্ময় জহরকে সেখানে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি : 'যেখানে হরিণের মাংস নিয়ে বনভূমি সারারাত কাঁদে।' কবি বোধহয় নিশ্চিত অনুভব করছে আমরাই আমাদের ভবিতব্যের জন্যে দায়ী। যাবতীয় ব্যর্থতা আমাদের।
অন্ধকার
জহর সেনমজুমদার
ছয় শতাব্দী আগে তোমার কাছে একটি ডোরাকাটা
পেখম চেয়েছিলাম, পাই নি
পাঁচ শতাব্দী আগে তোমার কাছে দুটি আল্পনা আঁকা
ডানা চেয়েছিলাম পাই নি
চার শতাব্দী আগে তোমার কাছে শ্রুতি মধুর
কুহুকুহু কান্না চেয়েছিলাম, তাও পাই নি
আজ আর কিছু চাহি না, শুধু
আমাদের গৃহের বাঁ দিকে আধো অন্ধকারে
একজন ব্যর্থ সন্ন্যাসী বসে আছে, তুমি তারে
রক্ষা করিও, ঝড়জলে রক্ষা করিও

Boier Haat™   |   © All rights reserved 2024.