লাস্ট বয় - অচ্ছুৎ বালকের ক্লাসরুম - সমালোচনা

লাস্ট বয় - অচ্ছুৎ বালকের ক্লাসরুম - সমালোচনা

বই নিয়ে আলোচনা

বর্ণপরিচয় মার্কেট থেকে বেরিয়ে ট্রাম-রাস্তায় নেমে মনে পরল - আরে, বইয়ের ওপর লেখকের সই তো নেওয়া হল না! সে যাকগে, উনি নিজের হাতে বইটা আমাকে দিয়েছেন - সেটাই যথেষ্ট। আটপৌরে পোশাক পরা, সদাব্যস্ত মানুষটা অনেক কথার পর বইটা আমার হাতে তুলে দিলেন - যেন নিজের একটা হৃদয়-খণ্ড পরশপাথর ভেবে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিলেন, যদি মনকে সোনা করতে পারে, খাঁটি করতে পারে।


আমারও আর তর সইছিল না, বইটার ব্যপারে অনেক শুনেছি। ‘লাস্ট বয় - অচ্ছুৎ বালকের ক্লাসরুম’ - অনেকটা লেখক অধীর বিশ্বাসের অব্যক্ত যন্ত্রণার কাহিনী, রতন নামের চরিত্রের মাধ্যমে ফিরে এসেছে। বাংলা সাহিত্যে প্রথম সাম্মানিক ‘পেন প্রেসেন্টস’ পুরস্কার প্রাপ্ত বই। ইংরাজিতে অনুদিত হয়েছে, খুব শিগগিরি ‘ওয়েস্টল্যান্ড প্রেস’ থেকে ছেপে বেরোবে।
ট্যাক্সিতে উঠে পরলাম। বইটা হাতে নিয়ে যতটা সম্ভব জানলার কাঁচের দিকে রেখে রাস্তার আলোয় পড়ার চেষ্টা করলাম। কলেজ স্ট্রীট, বিধান সরণী পেরিয়ে ছুটে চলল গাড়িটা, আর আমার মন, সুদূর পূর্ববঙ্গের কোন নদীর ধারে, রতনের সাথে, বাবার চুল-দাড়ি কাটার দোকানে লোক ডেকে আনার কাজ তার। একটু বেশি চুল-দাড়ি-ওয়ালা লোক দেখলেই যে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে, ‘ও কাকু চুল কাটবেন, দাড়ি কাটবেন?’
এভাবেই বাবার দোকানে তার পরিচয় হয় স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের সাথে। বাবার চুল কাটার ২ আনার বিনিময়ে যিনি রতন বিশ্বাসকে স্কুলে ভর্তি নিয়ে নেন। বাড়ি সুদ্ধু লোক - মা, বাবা মেতে ওঠেন রতনের স্কুলে যাওয়া নিয়ে। কিন্তু সেই স্কুল কি রতনকে মেনে নেয়? বিশ্বাস পদবী হওয়া সত্ত্বেও বাবার পেশার জন্য স্কুলের খাতায় তার নাম হয়ে যায় রতন 'পরামানিক'। ময়লা জামা, শীতকালে কানে পুঁজ - স্থান হয় এক্কেবারে লাস্ট বেঞ্চে। ক্লাসের মাস্টারমশাইও উঁচু জাতের ডানপিটে ছেলেদের পক্ষ নেন অজান্তেই, রতন তাঁর মাধ্যমেও বঞ্চনার শিকার হয়। একমাত্র সাথি দুলালও একদিন পেশার তাগিদে রতনকে ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে যায়। কিন্তু তাও রতনের যাত্রা থামে না।
রতনদের যাত্রা থামে না। রতনরাই ফিরে আসেন লেখক অধীর বিশ্বাস হয়ে। কিন্তু সেই স্কুল, সেই মাস্টার, সেই বঞ্চনা - সেগুলো কি চলে যায়? হয়ত না! অধীর বাবুর নিজের কথায় - এখনো কাজের ক্ষেত্রে তাঁকে শিকার হতে হয় বঞ্চনার, ‘ট্রলড’ হতে হয়। কানে পুঁজ, গায়ে গন্ধ, ময়লা জামা চলে গেলেও জাতের ছাপ গা থেকে যায়না!

ট্যাক্সির মধ্যেই বইটা পড়তে থাকি। রাস্তার আলোগুলো বইয়ের ওপর দিয়ে একে একে সরে যায় - যেন পুরনো দিনের বাইস্কোপ চলছে। রতন, বাবা, মা, দুলাল, রতনের দাদা, যে প্রায়ই কোথায় যেন পালিয়ে যায় আর বাবা বলে ওঠেন - ‘ও মরে না কেন?’ - সবাই কেমন যেন সে বাইস্কোপে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
কিন্তু আমি তো সাধারণ মধ্যবিত্ত পাঠক, অন্ত্যজ শ্রেণীর সংগ্রাম আমাকে কিভাবে এতটা নাড়া দিলো! প্রশ্নের উত্তর খুঁজলাম নিজের মধ্যে - উত্তরও পেয়ে গেলাম অনেকদিন আগের একটা ঘটনায়। আমি তখন সদ্য আঠেরো পেরিয়েছি, শরীরের রক্ত গরম, চনমনে। একদিন উইঙ্কল-টুইঙ্কল নাটকের মতো আমার আর আমার স্বর্গীয় পিতৃদেবের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে তর্ক শুরু হয়। আমি কিছু বেমানান কথা বলে ফেলি। উনি রেগে গিয়ে বলেন - রেগে গেলে সবসময় বাবা আমাকে 'তুমি' করে বলতেন, বললেন, “শোনো, তুমি কি কখনো যশোর রোডের দুধারে উদ্বাস্তু বসতি দেখেছো, দেখেছো একটু ফ্যানের জন্য লোকজন কিভাবে হা-পিত্তিশ করে বসে থাকে, দেখেছো খোস-প্যাঁচরা ওয়ালা শরীরে ওষুধ ঘষে দিলে কতটা আরাম হয়? দেখনি তাই না? তাই এসব কথা বলছ, যে কথা তোমার মুখে শোভা পায় না।”
এ তো অধীর বিশ্বাসের কথা - বাড়ির গরুর জন্য সারা পাড়া থেকে ফ্যান জোগাড় করে আনতেন, তলায় কিছুটা ভাত পরে থাকতো, তাই দিয়ে পেট ভর্তি হতো। রতনের কানের পুঁজ মা আঁচলের খুঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দিতেন, আরামে ঘুম পেয়ে যেতো রতনের।
তাহলে কি এ যন্ত্রণা আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত? আমরা চলে যাওয়া কালের গভীরে কোন ঘায়ের দাগ এখনো বয়ে নিয়ে চলেছি?
ট্যাক্সির সিটে দিকে হেলান দিলাম। শহরের আলোগুলো চোখের ওপর দিয়ে সরে সরে যেতে লাগলো। নড়ে যেতে থাকল আমার শেষ সম্বল - অস্তিত্ব।

Boier Haat   |   © All rights reserved 2023.