পরবর্তী প্রজন্মের আবেদন

পরবর্তী প্রজন্মের আবেদন

প্রবন্ধ ও রচনা
বাংলা সাহিত্য পড়া নিয়ে যখন আমি কিছু বলা শুরু করবো, তার আগে আমার এটা স্বীকার করা অত্যন্ত জরুরি যে বিগত দু’বছরে আমার নিজেরই নতুন কোনো গল্প, কবিতা, উপন্যাস পড়া হয়নি। কিন্তু তাও আমি কেন জানিনা বুঝতে পারি যে আজ আমার সমবয়সী বন্ধুদের মধ্যে নিজের ভাষার প্রতি কোনো টানই নেই। কিছু কিছু বাংলা গান শুনি যেখানে গানগুলোতে বাংলার থেকে অন্যান্য ভাষার শব্দ বেশি। তাদেরকে জুড়ে রাখার জন্যে কয়েকটি সর্বনাম রয়েছে বাংলায়; যেন কেউ ট্যাগ করে দিচ্ছে যে - ‘হ্যাঁ ভাই এটা আসলে বাংলা গান’। আবার অত্যন্ত ভালো বাংলা গানও আছে, যা সত্যিই হৃদয় স্পর্শ করে।
যখন তোমার মনের মধ্যে ইমোশনে শুধু অন্য ভাষা বাজবে, তখন এ জানবে যে তোমার ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে।
আমি নিজে জাপানীস আনিমের ভক্ত, কিন্তু আমার মনে ‘কোশাবেরি বিয়োরি’ র সাথে সাথে ‘দূর হতে আমি তারে সাধিব’ বাজে। আমি জানি ফিলিংস এর কোনো ভাষা হয়না, তাও বলবো, ভাষার ফিলিং হয়।
গান এক অত্যন্ত জরুরি মাধ্যম বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসার জন্যে। নানা ভাবে ছোটবেলা থেকেই এই প্রচলনটা দরকার, নইলে বড়ো হয়ে বাংলাটা শুধু দরকারহীন একটা ল্যাঙ্গুয়েজে সাবজেক্ট হয়ে দাঁড়াবে। অনেকেই এই দিকটাতে আলোকপাত করবেন, কিভাবে শিশুদের ছোটবেলা থেকেই বাংলার সাথে পরিচয় এবং বড় করে তোলা দরকার। আমি আর এদিকে যাবোনা। যারা বাংলাকে কোনোদিন গুরুত্ব দেয়নি স্কুলে, তাদের কথা ছেড়ে যদি আমি তাদের কথা ভাবি যারা স্কুলে এবং বাড়িতে বাংলা চর্চার ছোঁয়া পেয়েছেন, তাদেরও কিন্তু খুব ভালো অবস্থা নয় - উদাহরণ আমি নিজেই। আমার স্কুলের শিক্ষিকা এবং আমার মায়ের অনেক কষ্টের পরেও আমার সাথে আজ এই সাহিত্যের কেমন একটা দূরত্ব এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি এখন পড়া শুরু করতে চাইলেও কেমন যেন হারিয়ে যাই, এত কিছু পড়ার আছে, এত রকমের স্বাদ এর লেখা। কোনটা পড়বো বোঝা যায়না। আনিমে দেখি আমি সেই গল্পের শুন্যস্থান পূরণের জন্যে। অনেক রকম সাজেশন, নানা প্রকার এর genre -এ বিভক্ত কোনো একটি সাইট আমাকে এই কাজে সাহায্য করে। বাংলাতে যদি এমন কিছু পাই, যেখানে কোনো মানুষ একটু গুছিয়ে দিয়েছে কিছুটা, আমার জন্যে অনেক সুবিধে হবে পড়তে। ইচ্ছেও হবে। যেরকম সময়ে যেরকম ইচ্ছে সেই স্বাদ এর কিছু একটা পড়তে পারবো। এখন অডিওবুক এর ও প্রচলন, ট্রেনে অনেক্ষন বসে যদি কোথাও যাই তবে শুনতে শুনতে যাবো। আমার কাছে অনেক সহজলভ্য হয়ে যাবে তখন।
আমাদের আটেনশন স্প্যান খুবই কম, অনেক বড় গল্প ইত্যাদি কিছু শুধু পড়বো ভাববো হয়তো কিন্তু তারপর ইচ্ছে হারিয়ে যায়। আমার মতো অনেক বন্ধুই হয়তো একই রকম কিছুর সম্মুখীন। কিছু কিছু গল্পের উদ্ধৃত অংশ ও যদি পরিবেশন করা যায়, তাহলে সেটার ব্যপারে অনেক বেশি ইন্টারেস্ট জাগবে। ক্লাস ১০ এর বইতে পথের দাবি গল্পটার একটু ছোট অংশ পড়ে আমাদের নিজে থেকে ইচ্ছে হয়েছিল যে তার আগে পরে কি হলো আমরা পড়ি।
ইংলিশে “দ্যা রাইম অফ দি এনসিয়েন্ট মেরিনার” কবিতা র দুটো অংশ পড়ে এতটাই ভালো লেগেছিলো যে বাকি ৫ টা বড় অংশ নিজে থেকে পড়েছিলাম। এইরকম ভাবে, যারা সাহিত্য নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা যদি এরকম কিছু ছোট অংশ সামনে তুলে আনার ব্যবস্থা করেন, তবে আমরা যারা একটু দূরে দাঁড়িয়ে, আমরা আরো আগ্রহের সাথে যোগ দেবো বলেই আমার ধারণা। যারা পড়েন, যারা পড়তে চান, সবাই যদি একটু একটু করে সহযোগ দেন তাহলে যারা পড়েনা তাদেরকেও আস্তে আস্তে এগিয়ে আনা যাবে বাংলা সাহিত্য কবিতা গানের দিকে। একটা কিছু শেষ করে আমি অন্য কোথাও একটা শুরু করবো, কেউ আমাকে সাজেস্ট করবে যে ‘ভাই তুমি যেহেতু এইটা এইটা পড়েছো, তুমি একটু এটা দেখো তো কেমন লাগে’, এরকম একটা ব্যবস্থা করা দরকার আমাদের সকলের। আজকে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবকে তো অস্বীকার করা যায়না, যদি একটা ফোরাম হয় যেখানে আমরা অন্য মানুষকে দেখতে পারবো আমি কি কি পড়েছি, আলোচনা করতে পারি, তাহলে আর এটার ব্যবহার প্রচলন করতেও কষ্ট হবেনা। আমি যেটা একটা বিদেশী গল্প, আনিমে বা মুভিতে করতে পারি, সেই একই আলোচনার আসরটা আমি বাংলাতে পেতে চাই।

Boier Haat™   |   © All rights reserved 2024.