খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি
দীপক রায়
প্রচ্ছদ : মুক্তারাম মাইতি
প্রচ্ছদ রূপায়ণ : সন্তু দাস
আবহমান বাংলা কবিতা - এই কথাটি শুধুমাত্র তিনটি শব্দ দিয়ে তৈরি একটা বাক্য সেটা ভাবলে অনেকটা ভুল ভাবা হবে। দীর্ঘকাল ব্যাপী বাংলা কবিতা চর্চার এক সুদীর্ঘ ইতিহাস, সময়, কবিতার ভাষা থেকে কবিতা আঙ্গিক, আবার কবিতার বিষয় থেকে কবিতার প্রয়োগ - এই সব কিছু নিয়েই বাংলা কবিতার কাল পর্বের বিরাট এক যাত্রা। এবং এই যাত্রায় যিনি সর্বাগ্রে বিরাজমান তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রায় আড়াই হাজার কবিতা দিয়ে আবহমান বাংলা কবিতাকে বিশ্বের দরবারে তিনি যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, এত বড় প্রতিভা না থাকলে বাংলা কবিতাকে বিশ্বের দরজায় পৌঁছে দেবার এই চরম ও শ্রমের কাজ তিনি করে উঠতে পারতেন না। কবিতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ' প্রতিভা' শব্দ দিয়েই এখানে উল্লেখ করলাম।
পরবর্তীতে রবীন্দ্রপরবর্তী কবি সমাজ এবং তার পরবর্তী দর্শক অনুযায়ী কবিতাকে নিয়ে নানা ভাবনা ও আঙ্গিকের প্রয়োগ ঘটেছে বাংলা কবিতায় বারবার। চল্লিশের দশক, পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশক, সত্তর দশক এবং পরবর্তীতে শূন্য দশক পেরিয়ে আজকে দ্বি-বিংশ শতাব্দীতে কবিতাকে ভালোবেসে যারা কবিতা চর্চা করেন, নিয়মিত যারা কবিতা লিখেন, কবিতা পড়েন -- সবচেয়ে বড় কথা সমসাময়িক কত চিন্তক কবিদের কবিতা নিয়ে যারা নিয়মিত চর্চা করেন, পাঠ করেন এবং একই সঙ্গে পর্যালোচনা ও আলোচনায় কবিতার অভিমুখ - গতি - বিষয় - আঙ্গিক এবং প্রয়োগ সম্পর্কে নানাবিধ গবেষণা করে থাকেন তারা প্রত্যেকেই জানেন কবিতা এক রকমের শিল্প। পৃথিবীতে সর্বোৎকৃষ্ট শিল্প যদি চিত্রশিল্প হয়, তবে দ্বিতীয় সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ শিল্প তাহলে কবিতা। কবিতা একটি শিল্প এই কারণেই কারণ কবিতা লেখা হয় না, কবিতাকে নির্মাণ করতে হয়। অর্থাৎ খুব ভালোভাবে যদি বলি কবিতাকে কবিতায় তৈরি করতে হয়। এবং এই তৈরির কাজ তারা সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করে করতে পারেন, যারা দীর্ঘদিনব্যাপী এই কবিতা শিল্পকলার সাথে যুক্ত।
আমাদের বাংলা কবিতার কথা আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, কালিদাস রায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদ রঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, সজনীকান্ত দাস। এর পরবর্তীতে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, অমিয় চক্রবর্তী, অরুণ মিত্র থেকে শুরু করে পরবর্তীতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার এরপর শঙ্খ ঘোষ, কালীকৃষ্ণ গুহ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার এবং এর পরবর্তীতে ভাস্কর চক্রবর্তী, তুষার রায়, নবারুণ ভট্টাচার্য, মণীন্দ্র গুপ্ত, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভু রক্ষিত, জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকার, মৃদুল দাশগুপ্ত, সুধীর দত্ত, গৌতম চক্রবর্তী, সুজিত সরকার, দেবদাস আচার্য, শংকর চক্রবর্তী, শ্যামলকান্তি দাশ, অংশুমান কর অর্থাৎ কবিতার আলোচনায় এই সমস্ত নাম বারবার উঠে আসবে। এর বাইরে ও অনেক নাম আছে যেগুলো সব সময় কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে অনুসন্ধিৎসু পাঠক থেকে চিন্তক কবি তারা প্রত্যেকেই জানেন বাংলা কবিতার আবহমান চর্চার ইতিহাস।
তবুও এই বিরাট পর্বের একটি পর্ব যা শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্য নয় বাংলার সংস্কৃতি ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ৭০ দশক। উত্তাল সময়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এপার বাংলা ওপার বাংলার বিদ্বেষ। এরই সঙ্গে ঐতিহাসিক নকশাল আন্দোলন। পশ্চিমবাংলার কংগ্রেস পার্টি ও মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বিরাট পালাবদল, এবং সর্বোপরি যুক্তফ্রন্ট এর বিরাট জনমত ও জনভোট পেয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টির মসনদ দখল। এই বহুমুখী সামাজিক আন্দোলন এবং একইসঙ্গে শিল্প ও সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর প্রভাব -- এই সবকিছুই বাংলা সাহিত্যের বারবার উঠে এসেছে। এই সত্তরের কবিদের মধ্যে থেকেই কলকাতা থেকে অন্তত ৫০ কিলোমিটার দূরে থাকা কবি দীপক রায়। যার কবিতার ভাষায় রয়েছে ভিন্ন স্বর। প্রায় ১৫টি কাব্যগ্রন্থ, সম্পাদিত গ্রন্থ প্রায় ৩টি, অন্যান্য গ্রন্থ ৪টি, একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ এবং ১টি উপন্যাস। -- এই বিরাট গ্রন্থের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয় ও বিন্যাস সর্বদাই মাথায় রেখে তিনি প্রকাশ করেছেন। কবিতার ক্ষেত্রেও তাঁর স্বাভাবিক ও স্বতন্ত্র ভাবনা কবিতা পাঠকের মনকে করেছে আন্দোলিত। প্রায় চার দশক ধরে তিনি কবিতাকে সযত্নে লালন করেছেন আত্মগোপনে। তাঁর সেই চর্চা উঠে এসেছে গ্রন্থের পাতায় পাতায়। আজও দীপক রায় কবিতাকে নিয়ে সর্বোচ্চ ভাবনায় উত্তীর্ণ হতে পারেন নিজের সাবলীলতায় ও স্বতন্ত্রতায়। সমসাময়িক অসংখ্য অনুরাগীকবি ও পাঠক তাঁর কবিতার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন বারবার। কবিতাকে নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা, এবং কবিতাকে নিয়ে উচ্চাঙ্গ ভাবনা যা কবি দীপক রায়ের স্বতন্ত্রতা দাবি রাখে।
কবিতার ব্যাকরণের কথা মাথায় রেখে তিনি কবিতাকে নির্মাণ করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। কখনো দীর্ঘ কবিতা আবার কখনো কাহিনী কাব্য তাঁর কবিতাকে অনন্য মাত্রা দান করেছে আবহমান কবিতার চলার পথে। আসলে দীপক রায় জানেন কবিতা তিনি লিখছেন না, তিনি কবিতাকে নির্মাণ করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, এবং একই সঙ্গে আগামী দিনের পাঠকের কাছে তিনি কবিতার স্বাক্ষর রাখার সামান্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। আজও বৃহত্তর ও মহানগর কলকাতা শহরের রাজপথে, কলেজ স্ট্রিট ও বই পাড়ায় এবং কবিতার বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসে কলকাতা থেকে দূরে থাকা নিভৃতে কবিতানির্মাণকারী এই কবির নাম। আজও ৩০ বছরের কবিতা প্রেমী পাঠকের কাছে দীপক রায় সাদরে প্রবেশ করতে পেরেছেন তাঁর কবিতার ভাবনার জগতে। একজন কবিতা প্রেমী, কবিতা নির্মাণকারী শিল্পীর কাছে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিই বা হতে পারে।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি