মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি
উপেন্দ্রনাথ সেন
"এরূপ কিম্বদন্তী আছে মহারাজার মৃত্যুদিবসে কলিকাতার ব্রাহ্মণেরা অনাহারে দিবস অতিবাহিত করিয়া ছিলেন। সেই অবধি অনেক দিবস পর্য্যন্ত মফঃস্বলের ব্রাহ্মণেরা কাৰ্য্য উপলক্ষে কলিকাতায় আসিলে পীপাসায় কণ্ঠদেশ শুদ্ধ হইয়া গেলেও কলিকাতায় জলগ্রহণ করিতেন না। সেই সময় কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া অনেক ব্রাহ্মণ স্থানান্তরে গিয়া বাস করেন। মহারাজার মৃত্যুসংবাদে সমগ্র বঙ্গদেশ বিভীষিকাগ্রস্ত হইয়াছিল।”
- শ্রীসত্যচরণ শাস্ত্রী, মহারাজ নন্দকুমার চরিত
----------------
"৪ঠা-আগষ্ট, শুক্রবার ১৭৭৫।
শুক্রবার অপরাহ্ণ হইয়াছে, এমন সময় আমি মহারাজা নন্দকুমারের গৃহে প্রবেশ করিলাম। তিনি আমাকে সম্বর্ধনা ও সাদর সম্ভাষণ করিলেন; আমি উপবেশন করিলে এরূপ ধীর ও প্রশান্তভাবে আমার সহিত কথোপকথন করিতে লাগিলেন, তাহাতে আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। আমি মনে মনে ভাবিলাম কল্য যে এ জগতে তাঁহার শেষ দিন, তাহা বোধ হয় মহারাজ বিস্মৃত হইয়াছেন। আমি তাঁহাকে অবশেষে বলিলাম "অদ্য আমি আপনাকে শেষ অভিবাদন করিতে আসিয়াছি।" এই কয়েকটি কথা বলিতে বস্তুত আমার মনে অত্যন্ত কষ্ট উপস্থিত হইয়াছিল। আবার যখন ভাবিলাম যে, কঠোর কর্তব্যের অনুরোধে কল্য তাঁহার সহিত বধ্য ভূমিতে বাইতে হইবে, ও শোচনীয় দৃশ্যের আদ্যোপান্ত দেখিতে হইবে, ও সময়োচিত আজ্ঞাদি প্রদান করিতে হইবে, তখন আমার হৃদয় অত্যন্ত কাতর হইয়া উঠিল। অনেক কষ্টে সেই উচ্ছলিত মনোবেগ ধারণ করিয়া, হৃদয়কে দৃঢ় করিয়া তাঁহাকে আমি গবর্ণমেন্টের আদেশে, কর্তব্যের অনুরোধে, যাহা বলিতে আসিয়াছিলাম, তাহা বলিয়া ফেলিলাম। আমি বলিলাম "কলিকাতার সেরিফ বলিয়া কল্য আমাকে কর্তব্যের দায়ে বধ্য ভূমিতে আপনার সঙ্গে গিয়া আজ্ঞাদি প্রদান করিতে হইবে। এই সুযোগে আমি আপনার অন্তিম বাসনাগুলি সাধ্য মত পূর্ণ করিতে প্রতিশ্রুত হইতেছি। কল্য আপনার যেসমস্ত বন্ধুবর্গ ও আত্মীয়গণ বধ্যভূমিতে আপনার সহিত শেষ সাক্ষাৎ করিতে যাইবেন, তাহাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করা হইবে। আর আপনার পালকী ও বাহকগণ নিয়মিত সময়ে আপনার জন্য এই গৃহ-সম্মুখে অপেক্ষা করিবে।" আমি মুখে ধীর ভাবে তাঁহাকে এই সমস্ত জ্ঞাপন করিতেছিলাম, কিন্তু অন্তরে প্রবল ঝটিকা বহিতেছিল।
মহারাজা আমার সমস্ত কথা শুনিয়া, স্থিরভাবে, ধীর গম্ভীর স্বরে প্রভূত শিষ্টাচারের সহিত উত্তর করিলেন, "আপনার এ সদাশয়তার জন্য আমি বড় আপ্যায়িত হইলাম; এই জন্য আমি আপনাকে অন্তরের সহিত ধন্যবাদ দিই। পরমেশ্বর আপনার মঙ্গল করুন। আপনি আমার হতভাগ্য পরিবারগণের ও কুমার গুরুদাসের উপর কৃপাদৃষ্টি রাখিবেন ও তাহাদের তত্ত্ব লইবেন, ও ফ্রান্সিস ও জেনারেল সাহেবকে আমার হইয়া এই বিষয়ের জন্য অনুরোধ করিবেন।” তিনি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। পরে ধীরে ধীরে কপালে অঙ্গুলিস্পর্শ করিলেন- বলিলেন, "মহাশয়, অদৃষ্ট-লিপি কখনও খণ্ডন হয় না।" আমি তাঁহাকে সময়োচিত বাক্যে প্রবোধিত করিয়া বলিলাম, "মহারাজ! আপনি চিন্তিত হইবেন না। ফ্রান্সিস্ ও জেনারেল আপনাকে সাদর সম্ভাবণ দিয়াছেন, আর আপনার এই শোচনীয় পরিণামের জন্য তাঁহারা অত্যন্ত দুঃখিত; রাজা গুরুদাসকে তাঁহারা পুত্রের ন্যায় স্নেহ করিবেন, ও সর্ব্ব বিপদে রক্ষা করিতে ও উপদেশ দিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন।"
- আলেকজান্ডার ম্যাকরাবি ( কলকাতার শেরিফ)
ক্ষুদিরাম বসুর আইনজীবীর কলমে নন্দকুমারের বিচার নামক প্রহসনের তুল্যমূল্য বিশ্লেষণ পড়ুন -
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি