ঊর্মিমর্মর বিজয়নগর : ইতিহাস পুরাণ স্থাপত্য
অভিষেক চট্টোপাধ্যায়
উত্তরে কৃষ্ণা নদী আর দক্ষিণে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত শেষ হিন্দু সাম্রাজ্য বিজয়নগর। একদিকে তুঙ্গভদ্রার কল্লোলিত জলস্রোত অন্যদিকে হেমকূট, মাতঙ্গের গ্রানাইটের পিচ্ছিলতা, অগম্যতা, এই বৈপরীত্যের ভৌগোলিক সুবিধাপ্রাপ্ত বিজয়নগর হয়ে উঠেছিল অজেয়। অন্যদিকে ভারতীয় কলা, স্থাপত্য ও চিত্রকলার এক অভিনব দীপ্ত প্রকাশ এই সাম্রাজ্য। চতুর্দশ শতাব্দীতে ভিনদেশীয় আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে যখন দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে মরিয়া ঠিক সেই সময় বিজয়নগর তার খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করে ফেলেছিল তার বৈভবের উজ্জ্বল ছটায়। আর সেই সঙ্গে সৃষ্টি করেছিল অসূয়ারও। সেই উজ্জ্বল আলোকের ঝলকানি পৌঁছে গিয়েছিল সাগরপারেও। পর্তুগিজ থেকে শুরু করে ডাচ, পারসিয়ান থেকে আরব দেশীয় বণিক আর পর্যটকদের ভিড়ে গমগম করে উঠত প্রাচীন পম্পাক্ষেত্রের বাজারগুলি। পৌরাণিক কিস্কিন্ধা নগরীর পূর্ব ইতিহাস বা তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ বাণিজ্যনগরী হাম্পিকে কেন্দ্র করে চলা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের ব্যবসার সাথে সাথে বিজয়নগর নৃপতিদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা একের পর এক সুরম্য দেবালয় বা মণ্ডপ যাই হোক না কেন সবই ছিল এক অসাধারণ শিল্পকীর্তির নিদর্শন। বিজয়নগর শৈলীর সেই স্থাপত্যগুলির বৈশিষ্ট্য যেমন ছিল স্তম্ভসমৃদ্ধ বিস্তৃত সভামণ্ডপ বা রঙ্গমণ্ডপ ঠিক তেমনই ছিল সুউচ্চ গোপুরম শৈলী। গোপুরম রীতির প্রভাব সমগ্র দক্ষিণ ভারত জুড়ে দেখা গেলেও বিজয়নগরে রাজা দেবরায় বা কৃষ্ণদেবরায়ের সময় তা সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষতার চরম মান স্পর্শ করেছিল তা বলাই যায়। বেশকিছু নির্মাণের ক্ষেত্রে পুরাণের চিত্র আবার বেশ কিছুতে ইন্দো-ইসলামিক শিল্পরীতির সফল প্রয়োগ বিজয়নগর শৈলীর শিল্পচেতনার মধ্যে ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মসমন্বয় যেমন তুলে ধরে ঠিক তেমনই সায়ন, মাধবাচার্যের সনাতনী ধর্ম-টীকা হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের কথা বলে যায় নতুন করে। দেবালয় ও নির্মাণগুলিকে কেন্দ্র করে পুরন্দরদাস, ভগবানদাসের ভক্তি সঙ্গীত ও কীর্তন রচনা যা ভবিষ্যৎ কর্ণাটকী সঙ্গীতের ভিত্তিস্বরূপ তারও সূচনা এই বিজয়নগরেই। ভিঠঠল মন্দিরের রঙ্গমণ্ডপের কারুকার্য, সংগীতময় স্তম্ভ সবই এককথায় বিজ্ঞানসাধনার ও গাণিতিক হিসেবের নিখুঁত উদাহরণ। তালিকোটার যুদ্ধে বাহমনী গোষ্ঠীর মিলিত আক্রমনের পর ধীরেধীরে বিস্মৃতির অতলে চলে যায় সমগ্র বিজয়নগর। হয়ত বা কিছু বসতি তখনও অবশিষ্ট ছিল কিন্তু নির্মাণগুলি চূড়ান্ত অবহেলায় আর ধ্বংসের চিহ্ন বুকে ধরে ধীরেধীরে চলে যায় অবলুপ্তির পথে। কিন্তু বিভিন্ন পর্যটকদের স্মৃতিকথায় উজ্জ্বল বিজয়নগর কিন্তু একবারে হারিয়ে যায়নি। সে আবার স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করল আলেক্সান্ডার গ্রীনলর ফটোগ্রাফের মাধ্যমে। পুনর্জন্ম হয় বিজয়নগরের তৎকালীন রাজধানী হাম্পির। ভ্রমণপথের বাঁকেবাঁকে সেই নির্মাণগুলিকে ইতিহাস, পুরাণ আর স্থাপত্যের প্রেক্ষিতে খুঁজে দেখার এক প্রচেষ্টা বর্তমান প্রবন্ধ। হাম্পির মন্দির বা অন্যান্য নির্মাণগুলির স্থাপত্যশৈলীর সম্পূর্ণ বিবরণ আর সেই সঙ্গে তুঙ্গভদ্রার তীর ধরে ভেসে চলা ভ্রমণকাহিনি 'ঊর্মিমর্মর বিজয়নগর'।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি