ব্রতঠাকুরানির হাট
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
ব্রতঠাকুরানির হাট বইটিতে ভূতপেত্নীর কথা যেমন এসেছে তেমনি এসেছে অপদেবতা বা উপদেবতা প্রসঙ্গে প্রত্যন্ত লোক বিশ্বাসে নানারকম লোকায়ত দেবতার কথা। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বনঝাকরি, গদ্রবঙ্গা, হাড়ি ঝি চণ্ডী, আটেশ্বর, মাশান বাবা, যাখিন চন্ডী, রাঙাধর, বড় শিয়াল্যা, এঁটুঠাকুর, গোড়াভয় ঠাকুর, কাঁদুনেমাসি, বুড়াছা ও শিশি মাংজি, নিশিকান্ত, চণ, মগর, গঙ্গাসাগর, পৈরি ও পেত্তানি। এরা কেউ অসুখ বাধায়, কেউ শিশুদের ভয় দেখায় আবার এদের পুজো দিলে এরা খুশি হয়।শিশুর অসুখ সারে। কথায় কথায় অভিমান হয় যে এদের। তাদের সামনে দিয়ে কেউ ঠিকঠাক ভক্তি না দেখিয়ে হেঁটে চলে গেলে প্রতিশোধও নেয় তারা।
কালীপুজোর আগের দিন হয় ভূত চতুর্দশী। সেদিন ভূত তাড়াতে চোদ্দ পুরুষের উদ্দেশ্যে চোদ্দ রকমের শাক, ঘরের আনাচে কানাচে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানোর রীতি। অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তির বরণের উৎসব। অর্থাৎ নিজের ঘরের আত্মীয় প্রিয়জনেরা সেই আলো দেখে যাতে পথ চিনে যার যার নিজ আলয়ে ফিরে চলে যান মানে তাঁদের আত্মার শান্তিকামনায়। এসব তাহলে কিসের জন্য মানি আমরা?
ভূত আলপনার কথা পড়ে চমকে গেছি। মৃগাঙ্ক চক্রবর্তীর বইটি না পড়লে আমিও জানতাম না। ভূত চতুর্দশীর দিন ঘরের কোণায় পিটুলি গোলা দিয়ে আঁকা হয় ভূত দম্পতির পালকি করে আসার ছবি। স্ত্রী ভূতের কপালে আবার সিঁদুর ফোঁটা। অশরীরি ভূতেরাই সেই পালকি বয়।ওইদিন পূর্বপুরুষের আত্মারা তাদের আত্মীয়জনের কাছে আসেন পরলোক থেকে। এমন সব তথ্য যোগাড় করেছি পড়ে পড়ে।
তেমনি গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, অবনীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুর, স্বপন কুমার ঠাকুর, এদের বই আমাকে রীতিমত ভাবিয়েছে। প্রচুর ছড়া, গান সংগ্রহ করেছি। জ্বলদর্চি পত্রিকার নিয়মিত কলমে ভাস্করব্রত পতির সাহায্য নিয়েছি। এমন আরও অনেকে আছেন। বইতে তাঁদের নামও উল্লেখ করেছি।
যুগে যুগে অপদেবতারা মানুষজনের বিশ্বাসের আশ্রয়ে আশ্রিত হয়ে বেঁচে আছে অস্তিত্বের সন্ধানে। অপদেবতারা সত্যিই বাস করে কিনা এ তর্কে যাবো না। তবে অপদেবতার তাড়ানোর জন্য ওঝাদের ঝাড়ফুঁকের প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। আসলে আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে একটা করে অপদেবতা আর একটা করে দেবতার বসবাস। এখন সেই দেবতা আর অপদেবতার মধ্যে কার শক্তি বেশি হবে সেটাই হল আসল।
একেক সময় মনে হয় কেউ বলেন অপদেবতা নিয়ে বেশি চর্চার প্রয়োজন নেই। সমাজ পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? সে প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল রবিঠাকুরের কথা। তিনি যে বলেছিলেন 'দেশের লোক-সংস্কৃতির মধ্যে অতীত যুগের সংস্কৃতির এমন বহু নিদর্শনাদি সংগুপ্ত আছে যেগুলি আমাদের জাতির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপকরণ হতে পারে, ওই নিদর্শনগুলি গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করা প্রয়োজন।'
তাই আমাদের জানার কোনো শেষ নেই। এই জানা আর মানার মধ্যে কিন্তু বিস্তর ফারাক। তাই সম্ভব হলে অশিক্ষা আর কুশিক্ষার ভূত তাড়িয়ে অপদেবতার প্রচারে না মেতে ওঠাটাই হবে আমাদের শিক্ষিত সমাজের উদ্দেশ্য। এই বইতে তেমনি কিছু অপদেবতার গল্প রইল।
এছাড়াও ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের লৌকিক স্তরে যেসব দেবদেবী অধিষ্ঠান করছেন তাঁদের আবির্ভাব, পুজোর প্রচার এবং ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে নানা অনুষঙ্গ জড়িত যেগুলি খুব জনপ্রিয়। যার পেছনে আছে, কোনও প্রাকৃতিক দুর্বিপাক হতে রক্ষা পাওয়া বা কোনও পশুপাখি, কীটপতঙ্গ হতে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। ক্রমে ক্রমে এই লোকবিশ্বাস বিশেষত প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের জনগোষ্ঠীতে লোকাচারে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণপ্রান্ত থেকে উত্তর এবং রাঢ়বঙ্গের কৃষিজীবী জঙ্গলবাসী, নৌজীবী, জেলে প্রভৃতি মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত এইসব লোকদেবতারা। এমন ৩৭জন লৌকিক দেবদেবীর কথাও রইল এই বইতে। এরা কেউই যেন সমাজের মূল স্রোতে আর হালে পানি পেয়েও পেলেন না। উত্তরবাংলা থেকে দক্ষিণ, রাঢ় বঙ্গের এমন সব দেবতাদের পুজো আজও আমাদের ভাবায়। কেনই বা এরা পুজো পান? কী সেই ধর্মীয় কারণ? এসব নিয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছন এহেন ব্রতঠাকুরানি।সেইসঙ্গে আদিবাসী অধ্যুষিত বাংলার বিখ্যাত পরবগুলিও রইল বিশদে আলোচিত। সর্বোপরি এইসব লোকাচার সর্ব ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে এক মিশ্র সংস্কৃতির ঐক্যতান। তথাকথিত যুক্তিবাদীদের প্রচলিত ধ্যানধারণায় দেবতা, লোকদেবতা, অপদেবতা এবং উপদেবতাদের এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেওয়াই যায় হয়ত। কিন্তু তাহলে তো লোকসংস্কৃতির লোকায়ত ধ্যানধারণা নিয়ে বাকী সব চর্চাও তো মিথ্যে হয়ে যাবে। আপাততঃ যুক্তিবাদীদের উপেক্ষা করেই বিজ্ঞানমনস্ক ব্রতঠাকুরাণীর হাটের পসরা সাজানোর চেষ্টা।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি