মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭
কল্যাণ কুমার সরকার
প্রকাশক : মিত্রম
পরিবেশক : প্রগ্ৰেসিভ পাবলিশার্স
সেই রণ-দামামার প্রবল ঝঙ্কারে উদ্বেলিত হয়ে উঠল সমগ্র ভারতবর্ষ। অচিরেই অযোধ্যা ও কানপুরসহ উত্তরপ্রদেশের নানা প্রান্তে মহাবিদ্রোহ মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁসি, বিহার, ওড়িশা, দোয়াব বুন্দেলখণ্ড রোহিলাখণ্ড, মধ্যভারত, রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাওয়ালপিণ্ডি এবং দক্ষিণ ভারতের মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কেরালাতে এই বিদ্রোহ দাবানলের রূপ লাভ করল। এমনকি গোয়া ও পণ্ডিচেরিতেও এই বিদ্রোহ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।
তবে উত্তরপ্রদেশ, বিহার প্রভৃতি রাজ্যের কিছু এলাকায় এই ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ গণ-বিদ্রোহ তথা জনগণের মুক্তি-বিদ্রোহের রূপ লাভ করে। সাহারানপুরে, ফরাক্কাবাদ, বেরিলি, কর্ণাল প্রভৃতি অঞ্চলে সাধারণ জনগণ প্রথমে বিদ্রোহ শুরু করে। অযোধ্যার নবাবকে বিদ্রোহ করার কাজে সাধারণ জনমানুষই সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।
বলাই বাহুল্য, সিপাহীদের পাশাপাশি রাজন্যবর্গ, সামন্তশ্রেণি এবং সাধারণ জনগণ সিপাহীদের শুরু করা এই বিদ্রোহে বিপুলভাবে অংশগ্রহণ করে এই বিদ্রোহকে গণবিদ্রোহ তথা মহাবিদ্রোহে পরিণত করে। হিন্দু, মুসলমান এবং অভিজাত অভাজন নির্বিশেষে সাধারণ ভারতীয় মানুষজনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এই বিদ্রোহ যথার্থই গণ মুক্তির মহাবিদ্রোহ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি ইংরেজ (স্কটিশ) ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পল তাঁর দ্য লাস্ট মুঘল: দ্য ফল অফ আ ডায়ান্যাস্টি ইন দিল্লি নামক গ্রন্থে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে সকল ভারতীয়র ঐক্যবদ্ধ মুক্তি বিদ্রোহ তথা গণমুক্তি সংগ্রাম হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।
মহাবিদ্রোহকে বীরত্বব্যঞ্জকভাবে পরিচালনা করতে এগিয়ে এলেন বেশ কয়েকজন বিচক্ষণ ও সাহসী ব্যক্তিত্ব। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ প্রবল পরাক্রমে বুন্দেলখণ্ডে বিদ্রোহ পরিচালনা করেছিলেন। অযোধ্যায় মারাত্মক আকারের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেখানকার নবাব জিন্নাতমহল। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই জমিদারচ্যুত তালুকদারগণ একত্রভাবে অযোধ্যায় মারাত্মক গণ-বিদ্রোহ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁদের বিদ্রোহাত্মক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হয়ে অযোধ্যার সাধারণ মানুষ কৃষক সকলেই প্রবল উৎসাহে এই বিদ্রোহে যোগ দেয়।
কানপুরে বিদ্রোহটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নানাসাহেব। তাঁর সেনাপতি তাঁতিয়া টোপি ও বিশ্বস্ত অনুচর আজিমুল্লা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কানপুরে রেসিডেন্সী আক্রমণ করেছিলেন এবং সেখানে ইংরেজ নাগরিকদের ২০ দিন অবরোধ করে রেখেছিলেন এবং ইংরেজরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়।
বেরিলিতে বিদ্রোহটি পরিচালনা করেছিলেন রোহিলা সর্দার খান বাহাদুর খাঁ। বিহারে কুনওয়ার সিং প্রবলভাবে এই বিদ্রোহ পরিচালনা করেছিলেন। ফৈজাবাদে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মৌলবি আহমুল্লাহ। মহারাষ্ট্রে এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রঙ্গ বাপুজি গুপ্তে, সোনাজি পন্ট, ভীমরাও মুন্ডারগী, ফড়নবীশ, মৌলভি সৈয়দ আলাউদ্দীন, গুলাম গৌস, সুলতান বক্স, ছোটা সিং প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। এছাড়া বখত খাঁ নামক জনৈক সিপাহী ছিলেন সেই বিদ্রোহে বিদ্রোহী সেনাদের সর্বাধিনায়ক। এই রকমভাবে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সেনাগণ ও সাধারণ মানুষ দুর্জয় সাহস ও সীমাহীন দেশপ্রেম নিয়ে মহাবিদ্রোহে মরণপণে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই বিদ্রোহকে ভারতবাসীর গণমুক্তি বিপ্লবে পরিণত করেছিলেন।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন হল ভারতের হিন্দু ও মুসলিম জনগণের ঐক্য। আপামর ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিম জনগণের ঐক্যের ভিত্তিতে এই মহাবিদ্রোহটি ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ভারতের 'জাতীয় সম্রাট' হিসাবে ঘোষিত সম্রাট বাহাদুর শাহ ও হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে সকল ভারতীয়কে ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, "ভারতের হিন্দু-মুসলমান জাগ্রত হও। ভাইসব জাগ্রত হও।” ইংরেজদের পরাজিত করার লক্ষ্যে তিনি আরও বলেছিলেন, "সৃষ্টিকর্তার করুণা এবং তোমাদের বীরত্বে তারা (ইংরেজগণ) সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হবে, আমাদের সেনাদলে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, সমতাই আমাদের নীতি।" শুধু তাই নয়, এই বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য বজায় রাখার জন্য সম্রাট বাহাদুর শাহ মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব 'কুরবানি' ও 'ইদ' স্থগিত রেখেছিলেন এবং তাঁর মাধ্যমে তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ভিত্তিতে এই বিদ্রোহে ইংরেজ পক্ষকে পরাস্ত করতে তৎপর হয়েছিলেন। ফলে মহাবিদ্রোহটিই ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমান জনগণের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যের পথ প্রস্তুত করেছিল।
বলাই বাহুল্য, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহটিকে সূচনা করেছিলেন ক্ষুব্ধ ভারতীয় সিপাহীগণ। তবে তারা বিদ্রোহটির সূচনা ঘোষণা করলেও বিদ্রোহটি তার পরবর্তী পর্যায়ে কিন্তু আর তাদের (সিপাহীদের) মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং রাজা, প্রজা, জমিদার, তালুকদার এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও তা বৈপ্লবিক রোমাঞ্চ নিয়ে প্রসারিত হয়েছিল এবং সাধারণ ভারতীয় জনগণের রোমাঞ্চকর অংশগ্রহণে এই বিদ্রোহটি ব্রিটিশ বিরোধীগণ মুক্তি আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। তাইতো এই বিদ্রোহ চলাকালেই দিল্লি থেকে বিহার পর্যন্ত ভারতের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কিছুদিনের জন্য ব্রিটিশ শাসন লোপ পেয়েছিল। রেভারেন্ড লালবিহারী দে মহাশয় তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, সেই সময়ে উত্তর ভারতে ব্রিটিশ শাসন সম্পূর্ণভাবেই লুপ্ত হয়েছিল এবং এমনকি মধ্য ভারতেও ব্রিটিশ শাসন অনেকটাই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, এভাবেই এই বিদ্রোহটি ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রথম জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। এই সত্যটিকেই সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে বিদ্রোহী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন-
"হঠাৎ দেশে উঠল আওয়াজ-“হো-হো, হো-হো, হো-হো।”
চমকে সবাই তাকিয়ে দেখে-সিপাহী বিদ্রোহ।
আগুন হয়ে সারাটা দেশ ফেটে পড়ল রাগে,
ছেলে বুড়ো জেগে উঠল নব্বই সন আগে। একশো বছর গোলামিতে সবাই তখন ক্ষিপ্ত, বিদেশীদের রক্ত পেলে তবেই হবে তৃপ্ত!!...... নানা জাতের নানান সেপাই গরীব এবং মূর্খ, সবাই তারা বুঝেছিল অধীনতার দুঃখ; তাইতো তারা স্বাধীনতার প্রথম লড়াই লড়তে এগিয়েছিল, এগিয়েছিল মরণ বরণ করতে।..."—কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, 'সিপাহী বিদ্রোহ'।
আমরাও একান্তভাবে মনে করি যে, ১৮৫৭ সালে ভারতস্থ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিদ্রোহটি ছিল সকল স্তর ও শ্রেণির ভারতীয় জনগণের অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ত গণ-বিপ্লব তথা গণ-মুক্তিবিদ্রোহ। তাইতো এই বিদ্রোহটি একান্তভাবেই ছিল ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ভারতবর্ষের মুক্তির লক্ষ্যে আপামর ভারতবাসীর প্রথম গণ-বিপ্লব-ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পদচিহ্ন স্বরূপ। --লেখক
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি