সন্তানিকা
ছুটির ঘণ্টা পড়িতেই বগলে খানকয়েক বই খাতা লইয়া নরেশ বাড়ির পথটি ধরিয়া চলিতে থাকে। পশ্চাতে যে এক বুড়া ডিটেকটিভের মত তাহার গতিবিধি লক্ষ করিতে পিছু লইয়াছে, ইহা সে লক্ষ করে নাই। লক্ষ করিলে বুড়ার ক্ষুধিত দৃষ্টি হইতে নিজেকে বাঁচাইবার জন্য সচেষ্ট হইত।
নরেশ মাইনর স্কুলের ছাত্র, তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। ভূষণের পারিপাট্য নাই, চুলগুলি উদ্ধু-খুস্কু। অর্ধনলিন পাঞ্জাবীর হাতাটায় এক ছোপ কালির দাগ। উহা দ্বারা কখন সে মুখের ঘাম মুছিয়াছিল-মুখেও কালির সবুজ স্পর্শ লাগিয়াছে। কোঁচাটা মাটিতে লুটাইত যদি সে বাম হাতে উহা উঁচু করিয়া ধরিয়া না রাখিত। মোটের উপর বেশ নিরীহ গোবেচারা ছেলে। ক্ষুধার তাড়নায় বেশ একটু জোরে জোরেই পা ফেলিয়া চলিতে থাকে।
বুড়া তাহার সঙ্গে সমানে তাল রাখিয়া হাঁটিতে পারিতেছে না।
বুড়ার বয়স হইয়াছে নেহাত কম নয়। হাঁটু পর্যন্ত পরতে পরতে ধূলা লাগিয়াছে- যেন মোজা পরিয়াছে! বহু দূর হইতেই হাঁটিয়া আসিতেছে হয় ত। গায়ে একটা ছেঁড়া জামা, বাম কক্ষে একটা শত মলিন কাপড়ের পুটলি। শত তালি দেওয়া চটি জোড়াটা সে বাম হাতে রাখিয়াছে। ডান হাতে একটা পুরানো ছাতা আর একটি বাঁকা লাঠি। যেন একজন ঘোর পর্যটক! কোথা হইতে কেমন করিয়া সে জীবনের এই শেষের পথে আসিয়া পড়িয়াছে সে ইতিহাস একমাত্র সে-ই জানে। দুনিয়ার আর কে কে জানে জানি না।
নরেশের পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকিয়া পড়িয়াছে বুড়া।
বীরেশবাবু বেশ একটু ঝাঁঝালো সুরেই বলেন, মশায়ের নাম কি? থাকা হয় কোথায়?
হাঁটিয়া হাঁটিয়া বুড়া শ্রান্ত হইয়াছে। লাঠিটায় ভর রাখিয়া বসিয়া পড়ে মাটির উপর, বলে, আমার নাম ধনঞ্জয় ঘোষাল। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করছেন বাবু! বাড়ি আমার নেই। ছিল, সবই ছিল, এখন কিছু নেই। এখানে কি চান?
আজ্ঞে, বড় একটা আশা নিয়ে আপনার দ্বারে এসেছি। আপনার বাড়িতে ইস্কুলের ছেলে আছে, গৃহশিক্ষকের দরকার পড়ে নিশ্চয়। যদি আমাকে গৃহশিক্ষক হিসাবে আপনার গৃহে স্থান দেন তবে বিশেষ কৃতার্থ হই।
বীরেশবাবু আবার বৃদ্ধের আপাদমস্তক ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া বলেন, অন্যত্র চেষ্টা করুন। এখানে আপনার সুবিধে হবে না।
বুড়া একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলে, তা একটু আধটু অসুবিধা হলেই বা, আমি সব চালিয়ে নিতে
পারব। আপনি সে জন্য ভাববেন না বাবু। সংসারে আমার আর কেউ নেই। দোহাই আপনার, আমাকে নিরাশ করবেন না। বুড়ার সবিনয় কাতরতায় বাবুর মন গলিয়া যায়। সুর একটু নরম করিয়া বলেন, আপনি কোন শ্রেণী পর্যন্ত পড়াতে পারেন?
বুড়া বলে, আমি বরাবরই উচ্চ প্রাইমারী ইস্কুলে হেডমাস্টারি করে আসছি। কি করব, অদৃষ্ট মন্দ, ইস্কুল উঠে যায়, আর আমিও হয়ে গেছি একেবারে নিরাশ্রয়। বুড়া ধনঞ্জয় ঘোষাল থাকিয়া যায় বীরেশবাবুর বাড়িতে। বীরেশবাবু ধৰ্ম্মনিষ্ঠ কুলীন ব্রাহ্মণ। বুড়া খাইতে বসে বারান্দায়। এ-টা সে-টা দিয়া পেট পুরিয়াই......
অদ্বৈত রচনাসমগ্র
সে খায়, বুঝে, গিন্নীমার আদর আছে যথেষ্ট, মনটাও স্নেহ-প্রবণ। পেট চিনিয়া খাওয়াইতে জানে। ভাত বেঞ্জন পাতে দিয়া গিন্নীমা তাহার নিকটে দেওয়াল ঠেস দিয়া দাঁড়ায়, একথা সেকথা জিজ্ঞাসা করে। বুড়া ধনঞ্জয় বলিয়া যায় তাহার জীবনের কাহিনী।
ছেলেবেলায় খুব ভাল ছাত্রই ছিল সে। তবু তাহার গুরু মহাশয়ের কি কড়া শাসন! ও-বাবা! সে আজ অনেক দিনের কথা। চণ্ডীমণ্ডপের বারান্দায় পাঠশালা বসিত। প্রত্যেক ছাত্রের এক একখানা করিয়া ছোট মাদুর থাকিত। ছাত্ররা সুর করিয়া কড়াকিয়া, নামতা, ক-য় আকারে কা, এই সব মুখস্থ করিত, আর বালক ধনঞ্জয় উত্তর দিককার খোলা মাঠটার দিকে চাহিয়া চাহিয়া অনেক কিছুই ভাবিত। ভাবিত, পণ্ডিত মহাশয় কতক্ষণে ছুটি দিবেন, কতক্ষণে গিয়া সে হিজল-গাছের খোপ হইতে পাখীর ছানা পাড়িয়া আনিবে! হাঁ, পাখী পুষিবার সখ ছিল তাহার পুরা মাত্রায়। তারপর সে ছাত্রবৃত্তি পাশ করিয়া মাস্টারি-জীবন সুরু করে। ওঃ, সে অনেক কথা। তখনকার ছাত্রবৃত্তি ছিল আজকালকার এল-এর দাদা! কত কিছুই না তখন ছেলেরা শিখিত আর আজ... মাছের ঝোলটা হয়েছে অতি উৎকৃষ্ট মা-বলিয়া ক্রমাগত কয়েকটি গ্রাস মুখে পুরিয়া বুড়া আবার তাহার গল্প আরম্ভ করে-কত বামুন কায়েতের ছেলেকে সে মানুষ করিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। তাহার ছাত্রদের মধ্যে অনেকে এল-এ বি-এ পাশ করিয়াছে, অনেকে ডেপুটী মাজিষ্টর হইয়াছে। ওঃ, কতদিন সে মাস্টারি করিয়াছে! তাহার কত ছাত্রের চুল পাকিয়াছে, দাঁত পড়িয়াছে-আবার অনেকে চলিয়া গেছে ও- পারের ডাকে! কত হেডমাস্টার এখনও পথে দেখা হইলে তাহাকে সসম্মানে নমস্কার করে। এখনও সে বাঁচিয়া আছে। মস্তিষ্কের গোলযোগ মোটেই হয় নাই, সব মনে রাখিতে পারে। ছেলেদের পড়াইতে খুব ওস্তাদ সে, অনেক কায়দাকানুন জানে। বখাটে ছেলেদেরও মানুষ করিবার অনেক অভিজ্ঞতা সে তাহার সুদীর্ঘ মাস্টরি-জীবনে সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে। যে কোন যুবক মাস্টারের সঙ্গে সে প্রতিযোগিতা করিতে প্রস্তুত।
শিক্ষকতা কার্যকে সে প্রাণ দিয়া ভালবাসিয়াছে। এমন পবিত্র কাজ দুনিয়ায় আর দুটী আছে? ছেলে মানুষ করা, ভবিষ্যদ্বংশীয়দের গঠন করিয়া তোলা! সারাটা জীবন সে এই কাজে কাটাইয়াছে। জীবনের অপরাহ্ণ-বাকি দিন কটা এই কাজেই কাটাইতে পারিলে তাহার আজন্ম-সাধনা সফলতা লাভ করে।
আহার সারিয়া সড়ি ধুইতে যায়। গিন্নীমাকে মনে মনে প্রণাম করে। সে লক্ষ করিয়াছে গিন্নীমা তাহার প্রত্যেকটি কথা মন দিয়া শুনিয়াছে। এমন ধৈর্যশীল শ্রোতা সে জীবনে অল্পই পাইয়াছে। বাস্তবিক গিন্নীমা সোনার মানুষ...
সন্ধ্যার পর ছাত্র লইয়া বসে। তিনটি ছাত্র। নরেশ আর তার ছোট দুটি ভাই বোন। ভাইটি পড়ে বর্ণপরিচয়। বোনটির মুখ দিয়া এখনও স্পষ্ট কথা ফুটে নাই। নূতন মাস্টারের নিকট আজ হইতে অ আ শিখিতে সুরু করে।
এই সরল মোটা দাড়িওয়ালা নূতন জীবটিকে দেখিয়া খুকী ভয় পায় না-মনে কৌতূহল জাগিয়া উঠে, ভাব করিতে চায়। কোল ঘেঁষিয়া বসিতেও আপত্তি নাই। খুকীর এ একটি মস্ত গুণ...
নরেশ ভাবে এ কোথা হইতে আসিল? ইহার শাসনের গণ্ডীর মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টা থাকিতে হইবে। জীবনের এই নূতনতম সাথীটার কথা ভাবিতে বসে, পড়া ভুলিয়া মুখের দিকে তাকায়, প্রকাণ্ড শরীরটার দিকে চাহিয়া থাকে।
মাস্টার আলোটা একটু বাড়াইয়া দিতে মনোযোগ দেয়। মিনিটখানেকের জন্য সব চুপচাপ হইয়া নুতন জীবটিকে চাহিয়া দেখে। বাবু ও-ঘর থেকে ঝঙ্কার দিয়া বলেন, কি-রে নরেশ, সব চুপ যে! এই-ই বুঝি তোদের পড়া!
মাস্টার সচকিত-সচেতন হইয়া উঠে। নরেশকে দেয় এক ধমক। মৌচাকের অলি গুঞ্জনের মত
আবার পড়া চলিতে থাকে।
নরেশকে ধমক দিবার সময় খুকী মাস্টারের মুখখানার দিকে চাহিয়াছিল—এমন সরল মুখখানা এতখানি বিকৃত হইতে পারে। খুকী ভয় পায়, বলে, মার কাছে যাব। মাস্টার বলে, আগে পড়া শেখ,...
ছোট গল্প
পরে যেও মার কাছে।
খুকী ক্রমে ক্রমে কান্না জুড়িয়া দেয়। বুড়া আদর করিয়া খুকীকে কোলে তুলিতে চায়। খুকী নারাজ। এই দাড়িওয়ালা বিরাট মনুষ্যটা কি জুজু-বুড়িরই রূপান্তর! খুকী প্রাণপণ শক্তিতে কোল হইতে নামিয়া পড়িতে চায়। বুড়া একটা মজার ছড়া কাটিয়া খুকীকে হাসাইবার চেষ্টা করে। খুকী চীৎকার করিয়া কাঁদে।
বুড়ার এই সঙ্কটের কালে গিন্নীমা আসিয়া তাহাকে রক্ষা করেন। জীবনের দুই প্রান্তের দুইটি বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে রফা করিয়া দেন। আবার পড়াশুনা চলিতে থাকে।
ও-ঘর হইতে বাবু বলিয়া উঠেন, মাস্টারমশাই, আজকের মত পড়া বন্ধ করুন। ছেলেদের ছুটি দিন। ছেলেদের লক্ষ করিয়া বেশ একটি মুরুব্বিয়ানার সুরেই মাস্টার বলে, আজ এতটুকুতেই বিদায় দিচ্ছি-কাল কিন্তু ওটা হবে না। এত শীঘ্র ছুটি পাবে না।
এইভাবেই ধনঞ্জয় ঘোষালের ছাত্র মানুষ করা চলিতে থাকে।
মাস্টার তামাক টানে খুব বেশি। বাবুর নিকট হইতে পয়সা চাহিয়া লইয়া সে একটা কলি-হুঁকা, দুই পয়সার মাখা তামাক, ও এক পয়সার টিকা কিনিয়া আনিয়াছে। বাঁশের দুইটা চোঙ্গা সে আপন হাতেই তৈয়ার করিয়াছে তামাক টিকা রাখিবার জন্য। বাবুর ছেলে নরেশকে সে হুকুম দিতে ভয় পায়, বাবু যদি রাগ করেন! সে নিজ হাতেই তামাক সাজিয়া গুড়ুক গুড়ুক করিয়া টানে। এই বাড়িতে তামাক থেকো দ্বিতীয় প্রাণী নাই। সর্বেসর্বা সে-একাই জলভরা হুঁকার মধুর মধুর রব দ্বারা বাড়িতে তামাক-সুন্দরের অস্তিত্বের প্রমাণ ঘোষণা করিতে থাকে। তার মনে পড়ে আগেকার কথা, পাঠশালার ছুটির পর পাড়ার নবীন পাল, সাচুনী শীল, বিনোদ কর্মকার প্রমুখ পাঁচজনের সাথে কি আরামেই না তামাকের সদ্ব্যবহার চলিত! তখন এই তামাক কতই না ভাল লাগিত! আজ আর এমনটি হয় না। কোন ভাল জিনিষ কি একা একা উপভোগ করা যায়!
দুপুর বেলাটা সে গিন্নীমার নিকট বসিয়া সুর করিয়া মহাভারত পড়ে। গিন্নীমাকে মা বলিয়া ডাকিতে তাহার কোথাও বাধে না, যদিও তিনি তার মেয়ের সমান বয়সী। সুখে সুখী, দুঃখে দুঃখী-সেও এই পরিবারের একজন হইয়া দাঁড়াইয়াছে। জীবনটা যদি এইভাবেই কাটিয়া যায়! জীবনের সূর্যটা ডুবিরার আর কতটুকুই বা বাকি...। বাকি কয়টা দিন যদি এইখানেই থাকিতে পারে! চিরনিদ্রাটা যখন একদিন আসিবেই তখন... ভাবিতে তাহার কতকটা আনন্দ আসে। মৃত্যুর তিক্ততা সে জীবনে বহুবার অনুভব করিয়াছে। মরণের কথা স্মরণ হইলে আগে সে শিহরিয়া উঠিত। এখন সে মৃত্যুকে ভয় পায় না। কিন্তু বেঘোরে মরাটাকে সে বড় ভয় করে। কোথায় কোন পথের পার্শ্বে, বৃক্ষতলে, নদীতটে কিংবা উন্মুক্ত প্রান্তরে পড়িয়া মরিবে, ভীষণ পিপাসার কালে ক্ষীণকণ্ঠে জল জল বলিয়া চেঁচাইবে, কেউ শুনিবে না। তার ক্লান্ত নিমীলিত আঁখিযুগল বৃথাই আকাশে বার দুই মৃত্যুস্পর্শ হইতে পরিত্রাণের উপায় খুঁজিবে-কেহ দেখিবে না, কেহ শুনিবে না, ইহা সে বড় কষ্টের বিষয় বলিয়া মনে করে।
এখন মৃত্যুকে ভয় করে না সত্য। কিন্তু যখন প্রকৃতই মৃত্যু আসিয়া তাহার তুহিন শীতল হস্তদ্বয় স্পর্শ করাইবে-তখন যে বড় ভয় করিবে। একাকী সেখানে সে কেমনে মরিবে! আর মরিলেই বা কি, তাহার অসহায় অসাড় দেহটাকে লইয়া শৃগাল কুকুর শকুনিতে টানাটানি করিবে। একটা ভারি বিশ্রী ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইবে যে...
ভাবিতে ধনঞ্জয়ের শরীর শিহরিয়া উঠে। এখানে মরিতে পারিলে তার কোন ক্ষোভই থাকিবে না। নিঃসহায় বলিয়া জগতের কাছে এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে তার কোন অভিযোগই নাই। সে শুধু শান্তিতে মরিতে চায়...
সকাল আটটা বাজিতে না বাজিতেই ধনঞ্জয়ের বড় ক্ষুধা পায়। সে অন্য সব সহ্য করিতে পারে, গালমন্দও নির্বিকার চিত্তে হজম করা তার অসাধ্য নয়। কিন্তু ক্ষুধা সে সহ্য করিতে পারে না। এই সময়.....
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.