বিশিষ্ট গবেষক পল্লব মুখোপাধ্যায়ের লেখা গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘অথ বঙ্গ বয়ন কথা’
তাঁতের সঙ্গে আঁতাত
যে কোনও কিছু বুনতে গেলে বহরের দু পাশে মুখপাত বুনতেই হয়, তার সুতোও খোলের বা জমির সুতোর থেকে আলাদা হয়। একথা ঠিক যে ২০২৩-র জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি একটি জাতীয় স্তরের বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত একটা ছোটো খবরে প্রাণিত হয়ে তাঁত বিষয়ে লেখার ভাবনা তীব্রতা পায়। এই লেখাটা তৈরির শুরুতে মুখপাত বুনতে গিয়ে আমার শৈশব, বাল্য, কৈশোর, যৌবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে চোখের সামনে একটা ছবি ফুটে উঠছিল – এক বালক শরত শিশিরের ভোরে একটা মস্ত শিউলি গাছকে দু হাতে ধরে ঝাকাচ্ছে আর তার গায়ে মাথায় চারপাশে টুপটাপ করে কমলা বোঁটার শিউলি স্মৃতি ঝরে পরছে, তারা আজও তেমনই তাজা।
স্মৃতিতে আজও তেমনই উজ্জ্বল এক বালক তার অসম বয়সী বান্ধবীর সঙ্গে তাঁর হেঁশেলে বসে নানা রকম গল্প শুনছে আর দুহাতে মুড়ির আর নারকেলের নাড়ু। বান্ধবী তোকলিতে সুতোয় পাক দিতে দিতে গল্প বলছে– ‘জানিস দাদুভাই সেই কোন ছোটো বয়সে অজ পাড়াগাঁ থেকে এলাম এই গ্রামে। আমাদের বাড়ির যোতে কত তুলো হতো। তখন আমরা বলতাম- ঘন সরিষা পাতলা রাই/ নেংগে নেংগে কার্পাস পাই। বালকের উৎসাহী প্রশ্ন এই সুতো দিয়ে কি করবের জবাবে থুতনি ধরে আদর করে ছড়া কেটে বলছেন–
ধন ধন ধনিয়ে কাপড় দেব বুনিয়ে।
তাতে দেব হীরের টোপ।
ফেটে মরবে পাড়ার লোক
আমার শৈশব কেটেছে শহর থেকে অনতি দুরে যে গ্রামে সেখানে ধর্ম বর্ণে প্রচ্ছন্ন বা প্রকট বিভাজন না থাকলেও একটা সূক্ষ্ম অনুচ্চারিত পেশাগত শ্রেণী বিভাজন ছিল। তাই কালো পিচের রাস্তাটা মুকুজ্জে, বাঁড়ুজ্জে, ঘোষ, মোড়োল, চাটুজ্জে, গুপ্ত, কাঁড়ার, মাল, গাঙ্গুলি আর ভটচাজদের দালান কোঠা, উঠোন, মাঠ, ডোবা আর ছোটু গোয়ালার বিশাল খাটালকে কোলে কাঁখে রেখে যেখানে পাকাপাকি ভাবে বাঁ দিকে ঘুরে গেছে সেইখানে ডান দিকে দুটো অপরিসর ইটপাতা রাস্তা ভেতরে ঢুকে প্যাঁচে প্যাঁচে জড়িয়ে রেখেছে মাটির, ছিটেবেড়ার, বাঙ্গালে দর্মার আর পলেস্তারাহীন দাঁতবারকরা ইটের দেওয়ালের ওপর খোলার, খাপড়ার, টালির আর মরচে ধরা টিনের চালের প্রায়ান্ধকার, সকাল সন্ধ্যায় কাঠের উনুনের ধোঁয়া ওঠা আর সাঁঝে কেরোসিনের কুপি জ্বলা ঘর। সেই সব ঘর থেকে মানুষেরা প্রতি সকাল সন্ধ্যে আসতেন রাস্তার বাঁকের এ পারের সমাজের হুঁ হুঁ গোছের লোকেদের আলোকিত বাড়িতে ঘুঁটে, কয়লার গুল বিক্রি করতে, বাসন মাজতে, উঠোন ঝাঁট দিতে, কাপড় কাচতে, ঘর মুছতে, ফাইফরমাস খাটতে, ছেলেপিলে সামলাতে। ও দুটির একটি গলিতে ছিল এক বিশাল টিনের চালের মাঠ ময়দান মার্কা ঘর। তার একবুক সমান ইটের পাঁচিল। তার ওপর লম্বা করে জানলার সারি। ঘরের মধ্যের ঝুঁজগো অন্ধকারে অনেক মানুষ একেকটা যন্ত্রের সামনে বসে দ্রুত গতিতে দু হাত পা নাড়ছে। মুখে কোনও কথা নেই কারো আর প্রত্যেকটা যন্ত্রে দু মাথায় লোহা লাগানোএকটা কাঠের পটলের মতো কি পেটের মধ্যে রঙিন সুতোর কাঠিম নিয়ে যন্ত্রের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত আওয়াজ তুলে অবিশ্রান্ত গতিতে ছুটছে। সেই চালার অনতি দুরে একটা সাদামাটা এলা ফেরানো বাড়ি। জানলা দরজায় আলকাতরার কালো পোঁচ আর বাড়ির কোলে পাঁচিল ঘেরা মস্ত এক উঠোন। সেখানে নানা রঙে ভরতি গামলায় পুরুষেরা সুতোর গুচি ভিজিয়া নিংড়ে বাঁশে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। মেয়েরা বউরা বাঁ হাতে সুতোর টিপনি ধরে এক মনে চরকা ঘুরিয়ে যাচ্ছেন। তা থেকে বেশ একটা রাগি ভোমরার মতো গোঁ গোঁ আওয়াজ উঠছে। তবুও আমাদের উত্তর-শৈশব আর বাল্য বয়স আর প্রাক-কৈশোরে স্কুল ফেরতা পথে সুযোগ বুঝে কখনও কখনও পরিবারের আর পাড়ার বারোয়ারি অভিভাবকদের চোখ এড়িয়ে ওদিকটায় যাওয়ার বারন-রেখা পার করে গলির মধ্যে উঁকি মারাটা ছিল আমাদের এডভেঞ্চার। তারপর, জীবন জীবিকার খোঁজে শামুকের মতো বাস্তু পিঠে করে হেথা হোতা জীবন যাপন। মন থেকে কোথায় সে সব হারিয়ে গেছে। সেই আধা গ্রাম এখন বহিরাঙ্গে অচেনা এক প্রায় শহর। গত শতকের নয়ের দশকে আনন্দবাজারের শনিবারের পত্রিকার সু্দেষ্ণা বসুর উৎসাহে আর প্রবাসী আনন্দবাজারের সুজন চন্দের সংক্ষিপ্ত আদেশে মাঝেমাঝেই শাড়ি, ফ্যাশান এসব নিয়ে ফিচার লিখতে হয়েছে। কিন্তু ওই অবধি। বয়ন কেন্দ্রগুলি ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে লেখা হল, ছাপা হল আর টাকা পেলাম, ব্যাস আর কিছু নয়।
এখন বুঝছি যে আমার অজান্তেই কবে যেন তাঁতের সঙ্গে আমার এক গোপন আঁতাত গড়ে উঠেছিল। আমি আমার মন-গহনের কথা বুঝতে পারিনি। তাই কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার লাইন ধার করে বলতেই হয়- “কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি”। কোনও দিন না ভাবলেও সেই সব স্মৃতিরা লেখাটাকে সম্পুর্ণ করতে সাহায্য করেছে। বহু তথ্য দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার পুরাতন বন্ধুনী শ্রীমতি সু্দেষ্ণা বসু। তাঁর কাছে আমার ঋণের অন্ত নেই। ভারতীয় মহাকাব্যের ভাষ্যকার বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অধ্যাপক শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয় তাঁর মূল্যবান সময়ের অপচয় করেছেন মহাকাব্যিক তথ্য দিয়ে।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.