টেক পুরাণের ঠেক
নিখাদ বাঙালি
প্রথম প্রশ্ন আসে, বইয়ের এরকম একটা অদ্ভূত নাম কেন? অর্থাৎ ‘ঠেক’ কথাটা পড়ে তো বোঝা যাচ্ছে যে গল্প আড্ডার ব্যাপার, কিন্তু ‘টেক (Tech)’, মানে টেকনোলজির সাথে পুরাণের সম্পর্কটা কীরকম ভাবে হচ্ছে?
এখানে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার আগে অন্য একটা গল্প বলি। গল্পটা বছর চারেক আগের। কোভিডের আগেই। আমার ভাগনে-ভাইঝিদের মধ্যে সবথেকে শান্ত যেটি, সেই আদরে ভাইঝিটি একদিন আমাকে অ্যাভেঞ্জারস নিয়ে বলছিল। সিনেমা ও সিরিজ দেখে সে রীতিমতন মারভেলের ফ্যান। ব্যক্তিগতভাবে আমি ডিসি ফ্যান হলেও, মারভেলের কিছু চরিত্র ও গল্প আমার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু সেই কমিক্সের আলোচনা অন্যদিন হবে। মোটামুটি আমার ভাইঝিটি আমার সাথে বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে আলোচনা করছিল এবং তাদের অরিজিন স্টোরি নিয়ে জিজ্ঞেস করছিল। অর্থাৎ কীভাবে একেকজন সুপারহিরো নিজেদের সুপারপাওয়ার পেয়েছে।
হেনকালে প্রসঙ্গে আসে থর ও লোকি। কমিক্সে কিন্তু থরের শক্তি পাওয়ার একটা গল্প ছিল প্রথমদিকে। তখন দেবতা থর আসেনি, থরের শক্তি পেত ডোনাল্ড ব্লেক বলে একজন, কিন্তু সেই গল্পটা নেই আর। সিনেমাতেও নেই। এখন তারা দেবতা, এবং অ্যাসগার্ডে থাকে, তাই তাদের বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা (সুপারপাওয়ার) আছে। ভাইঝি যথারীতি সেটাই মেনে নিয়েছে, এবং বলে “ওরা তো দেবতা”।
আমি তখন তাকে জানাই থর নিজেই সত্যি একজন দেবতা চরিত্র, এবং থর, ওডিন, লোকি, ফেনরির এরা সবাই নর্ডিক মাইথোলজির অংশ। এমনকি র্যাগনারকের গল্পও সেখানকার, আর ইজ্ঞদ্রাসিল (Yggdrasil) গাছ যে ন’টা লোক ধরে রেখেছে সেটাও নর্স পুরাণের অন্তর্গত। এটা জানার পরে স্বাভাবিকভাবেই আমার ভাইঝির চোখ বড় বড় হয়ে যায়, এবং সে আরো জানতে যায়। তবে কিছুক্ষণ পরেই ভাইঝি একটু নিরাশ হয় কারণ সিনেমা বা কমিক্সের থর বা লোকির সাথে মাইথোলজির থর-লোকির অমিল অনেক। উপরন্তু তার ততক্ষণে মনে পড়েছে, সে প্রফেসর শঙ্কুর গল্পেও ওডিন-থরের উল্লেখ পেয়েছে। ভাইঝি তখন প্রশ্ন করে- “তাহলে ওদেরকে এরকম বদলালো কেন?”
কঠিন প্রশ্ন। একজন ক্লাস সেভেনের পড়ুয়াকে আমি কীকরে কমিক্স ইন্ডাস্ট্রি আর এন্টারটেনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির লাভ ক্ষতি বুঝাই? উপরন্তু এটাই বা বোঝাই কীকরে যে এইভাবে অন্য মাইথোলজির গল্প আর চরিত্রকে নিয়ে তাকে দুমড়ে-মুচড়ে বিনোদনের মাধ্যম বানিয়ে দেওয়াটাও একপ্রকারের ধর্মীয় ইঙ্কুইজিশন? সিনেমা ও কমিক্সে বারংবার নর্ডিক দেবতাদের, তাদের স্বর্গকে, তাদের কীর্তিকলাপকে বাইবেল, আমেরিকার কালচার ও খ্রীষ্টান ধর্মের দিকে ঘেঁষিয়ে দেওয়াটা ইঙ্কুইজিশন ছাড়া আর কী? এসব কীকরে বলা যায়, এবং আদৌ বলা ঠিক কিনা ভাবছি, তখনই ভাইঝির দ্বিতীয় প্রশ্ন ধেয়ে আসে- “আমাদের রামায়ণ-মহাভারতেও তো এরকম সুপারপাওয়ার সহ সুপারহিরো আছে”
আমি ভেবে দেখি, কথাটা তো ঠিকই বলেছে। হনুমান, কৃষ্ণ, রাম, গরুড়, শিবঠাকুর, অর্জুন, ভীম সবাই তো সুপারহিরো। বলা যেতেই পারে হনুমান থেকে সুপারম্যান এসেছে, ভীম থেকে হাল্ক, অর্জুন থেকে গ্রীন অ্যারো। এসেছেই সেটা বলছিনা, কিন্তু আমাদের পুরাণ ঘাঁটলে এরকম হাজার হাজার সুপারহিরো আর সুপারপাওয়ার বেরিয়ে আসবে। তার উপরে রয়েছে অদ্ভূত অদ্ভূত অস্ত্র। মহাভারতেই তো গাদাখনেক অস্ত্র আছে যেগুলোর সাথে উৎসাহী মানুষেরা পারমাণবিক বোমার মিল খুঁজে পায়। আবার রামায়ণে দেখুন সেখানেও এরকম অস্ত্র ভরে ভরে আছে।
এই কথা জানাতেই ভাইঝি উদাহরণ চেয়ে বসে। আমি তাকে কল্পনা করে একটা উদাহরণ দিই, শব্দভেদী বাণ। জিনিসটা একটা গাইডেদ মিসাইল, যেটার মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ ইনপুট করে দিলে সে গিয়ে সেটাকেই আঘাত করবে। আপনি হরিণ মারতে চান? হরিণ জল খাচ্ছে? আপনি শব্দটা শুনতে পাচ্ছেন? গাইডেড মিসাইলে সেই শব্দটা রেকর্ড করে নিন। মিসাইলের প্রোগ্রামিং সিস্টেম নিজেই ক্যালকুলেট করে নেবে কতদূরে কোনদিকে সেই শব্দটা হচ্ছে, এবং মিসাইল ফায়ার করতেই সে সেই পথ খুঁজে টার্গেটে লাগবে।
ভাইঝি ভীষণ খুশি এই উত্তর পেয়ে, কিন্তু এই একটি উত্তর দিতে গিয়ে আমি দুটো পুরনো প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই। প্রথম প্রশ্ন হল, আমাদের দেশের পুরাণগুলোতে এত এত গল্প থাকা সত্ত্বেও, কেন নতুন প্রজন্ম সেগুলো জানেনা? বা বলা ভাল, জানার চেষ্টা করেনা? তার একটা কারণ হচ্ছে, পুরাণগুলোকে ধর্মের সাথে মিশিয়ে দিয়ে এমন একটা জায়গায় রেখে দেওয়া হয়েছে, যে নতুন প্রজন্ম সেগুলো জানতে গিয়ে হয় হাঁপিয়ে যায়, নয়ত হেসে ফেলে। আপনাদের বুঝতে হবে, দেশে যতই ধর্মের ধ্বজাধারীরা ধর্মের নবজাগরণ করার চেষ্টা করুক না কেন, এই পুরাণের গল্পগুলো যতদিন না সবার কাছে সর্বগ্রাহ্য রূপে পৌঁছচ্ছে ততদিন নতুন এবং আগামী প্রজন্ম এগুলো জানবে না, শিখবে না। ঢেঁকি গেলানো বা তোতাপাখির মুখস্থ করানোর মতন হয়ত তারা পড়বে, কিন্তু গ্রহণ করবে কী? যেমন তারা হ্যারী পটার গ্রহণ করেছে? স্টারওয়ার্স? টার্মিনেটর? মারভেল-ডিসি?
তারা করবেনা, কারণ নতুন প্রজন্ম টেকনোলজিতে যথেষ্ঠ এগিয়ে গেছে। মোবাইলের যে ফাংশন শিখতে আমার কয়েকমাস লেগেছে, সেটা আমার তিন বছরের ছেলে কদিনেই তুলে নিয়েছে। আজকের প্রজন্ম সায়েন্স বোঝে, লেজার বোঝে, জেট টেকনোলজি বোঝে, ন্যানোবট বোঝে, অত্যাধুনিক বন্দুক বোঝে, এয়ারোডাইনামিক্স বোঝে, ক্যেমিয়াল রিয়াকশন বোঝে। এদেরকে আপনি যদি বলতে যান, জঙ্গলে থাকা ঋষি চোখ বুঝে ঢ্যাং করে অভিশাপ দিল, তখন নতুন প্রজন্ম জিজ্ঞেস করে, অভিশাপ ব্যাপারটা বৈজ্ঞানিকসম্মতভাবে ঠিক কী? কেন সেটা দিলে বাকিদের সেটা মানতেই হত। আবার আপনি যদি বলতে যান, যে একটা ঘাস থেকে ব্রহ্মাস্ত্র বানানো যেত, আর সেটা একটা অঞ্চল ধ্বংস করে দিতে পারত, তাহলে নতুন প্রজন্ম জিজ্ঞেস করবে, কী এমন টেকনোলজি ছিল যে ঘাস থেকে অ্যাটম বোম তৈরী হয়ে যেত?
এইরকম নানাবিধ প্রশ্ন আমাদের বাড়ির বাচ্চারা এবং কিশোর-কিশোরীরা প্রায়ই করে থাক। এবং আমরা তাদের বলে দিই- “এসব প্রশ্ন করতে নেই, ঠাকুর পাপ দেবে”। তার কারণ আমরা নিজেরাও উত্তর জানিনা, আর আমরাও ছোটবেলায় এই প্রশ্ন করে বাড়ির লোকেদের কাছে এই একই উত্তর পেয়েছি। এই যে একটা অপরাধবোধ, যে পুরাণ বা রামায়ণ-মহাভারতের কোনো ব্যাপার নিয়ে সাধারণভাবে প্রশ্ন করলেই সেটা পাপ হয়ে যায়, এর ফলেই আর চর্চা হয়না। পরের প্রজন্ম তো ছেড়েই দিন, আমাদের প্রজন্ম বা আমাদের বাবা-মায়েদের প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে বলুনতো, ঠিক কটজন মানুষ পুরাণকে আগ্রহসহকারে পড়েছেন বা চর্চা করেছেন? খুবই কম কয়েকজনকে পাবেন। আর বাকিদের থাকে সিরিয়াললব্ধ জ্ঞান।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, এই যে পৌরাণিক ঘটণাগুলো বা অস্ত্রগুলো, এগুলো কী শুধুই দৈব মায়া, কীর্তি ও ইন্দ্রজাল? এগুলো কী শুধুই গল্পকথা নাকি পিছনে রয়েছে অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের প্রয়োগ? এখানে একটা ব্যাপার আসে। পুরাণের বিজ্ঞানকে যুগে যুগে মানুষ নিজেদের জ্ঞাত বিজ্ঞান দ্বারা বোঝানোর চেষ্টা করেছে। দেড় হাজার বছরে পুরাণের ভাষা হয়ত অল্প পরিবর্তন হয়েছে, নতুন জিনিস কমই ঢুকেছে, কিন্তু যখন তীর-ধনুক তরোয়াল ছিল, তখন সেগুলো দিয়েই বোঝানো হয়েছে ব্রহ্মাস্ত্র-পাশুপাতাস্ত্র। আবার যখন মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কার করল, তখন পুরাণের অসস্ত্রের সাথে তার মিল পাওয়া শুরু হল। যখন ওপেনহাইমার অ্যাটম বোম ফাটালেন, তখন ব্রহ্মাস্ত্রের সাথে তার মিল পাওয়া গেল। অর্থাৎ এই পৌরাণিক কাহিনীগুলোর সত্য-অসত্য জানার কোনো উপায় থাকুক না থাকুক, তাতে লিখিত যে অদ্ভূত অস্ত্রসকল বা কান্ডসকলের বিবরণ রয়েছে, সেটা আমরা যতটুকু বিজ্ঞান জানি সেটুকু দিয়েই বোঝার ও বোঝানোর চেষ্টা করি। কাল যদি নতুন কিছু আবিষ্কার হয় সেটা দিয়েই আমরা পুরাণের কাহিনীগুলোকে বুঝব। কিন্তু সেই বিজ্ঞানের কারণ ছাড়া আপনি কিশোরদের বোঝাতে পারবেন না পুরাণ।
তাই এখনকার যুগে দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্মকে তাদের ভাষায় পুরাণের গল্প জানানো একান্ত প্রয়োজন। নয়ত এগুলো হারিয়ে যাবে। গ্রীক-নর্ডিক-কেল্টিক-অগ্নিউপাসক-ইনকাদের ধর্মের মতন হিন্দু ধর্ম (ও, এখন তো সনাতন বলতে হয়) হারিয়ে যাবে নয়ত ধিকধিক করে জ্বলবে। তাই আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা, পুরাণের তিনটে বড় গল্পকে (বা ঘটনাকে) যথাযথ আজকের বিজ্ঞান ও কিছুটা কল্পবিজ্ঞান মিশিয়ে বলার। সেই তিনটি গল্প হল- সমুদ্র মন্থন, শুম্ভ নিশুম্ভ বধ (যার মধ্যে ধূম্রলোচন, রক্তবীজ ও চন্ড-মুন্ড বধ রয়েছে) এবং ত্রিপুরাসুরবধ।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.