অন্তরীপ এপ্রিল সংখ্যা ২০২৪ : প্রতিরোধ
অন্তরীপের নববর্ষ সংখ্যা সেজে উঠেছে কিছু অনামা অথচ দুর্বার প্রতিরোধের স্ফুলিঙ্গকথায়। ৩টি উপন্যাস, ৭টি গল্প, ৬টি কবিতা, ১টি প্রবন্ধে পত্রিকার দুইমলাটের ভিতর ফুল্ল হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ বিদ্রোহ প্রতিরোধের অনন্য কিছু যাপন, ইতিহাস। সে-ইতিহাসের ভিতর আপন দাবিতে সমুজ্জ্বল হয়ে জেগে রয়েছে বিস্মৃত বাঙালিদের বর্গী আক্রমণের প্রতিরোধ, নীল চাষিদের মরণপণ বিদ্রোহ, বাঙালি তন্তুবায়দের সম্মিলিত প্রতিবাদ।
**************************************************
নিকষ কালো নিষ্ঠুর অন্ধকার। দুর্দম ইংরেজের মতোই পৈশাচিক উল্লাসে টুঁটি টিপে ধরতে এগিয়ে আসছে। খর আলো জ্বালিয়ে থাকা খদ্যোতেরা মশাল নিয়ে তল্লাশি করে বেড়াচ্ছে জঙ্গলের আনাচ-কানাচ। ডাঁশ-মশাদের কামড় তো নয়, যেন ঝাঁকে ঝাঁকে সিপাই-বরকন্দাজের বল্লমের খোঁচা। নেপথ্য থেকে কোথাও কালো কালো, ভুখা নারী-পুরুষের সম্মিলিত আর্তনাদ যেন ক্রমশ ঝাঁপিয়ে এসে গ্রাস করতে আসছে নৈশ আগন্তুককে।
না না, আর্তনাদ কোথায়? এ তো ঝিঁঝিপোকার সমস্বরে একটানা হাহাকার।
বাতাসটাও কি গারদে আটক? গুমোট কান্না কাঁদছে নিশ্বাস চেপে? কারা সব দাঁড়িয়ে সারে সারে? বিশাল সব মহিরুহ, নাকি ওরা তীব্র ভয়াল চেহারার ফাঁসুড়ে জল্লাদ? আকাশেই বা ওটা কী? কোম্পানির সিপাইয়ের লাল পাগড়ি? না না, পাগড়ি কেন হবে? ও তো ক্ষয়াটে লাল চাঁদ!
অন্ধকারে যত এগোনো যায়, জমাটবাঁধা কালো আরও যেন চাপ হয়ে চেপে বসে। অন্ধকার, অন্ধকার এবং তারপরে আরও অন্ধকার। বেজি, ভাম, খাটাসের আস্তানা এ জঙ্গল। দিনেরবেলায় এদিক-ওদিক গাছের ডালে ঝুলে থাকা বাদুড়ও চোখে পড়েছে। তারাও হয়তো বা নিরাপদ নয় আর।
আহ! ডুবে থাকা অন্ধকারে একটা গাছের গুঁড়িতে কি কোনও পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ল বুড়ন। ফুলকুসমার বুড়ন সিং। পলাশীর যুদ্ধের বছরে যার জন্ম। বাপ ছিল পাইক। চোদ্দোপুরুষ ধরে তাদের ভোগদখল করা পাইকান জমি কবে চলে গেছে ইংরেজের জিম্মায়। অন্য রায়ত বসিয়ে দিয়েছে হারামি ইংরেজগুলান!
রক্ত ঝরছে পায়ে। টাটাচ্ছে খুব। কিন্তু সেদিকে মন দেবার মন এখন নেই তার। কোঁচড়ে মুড়ির মধ্যে হাত ঢোকাল সে। নাহ্, চিঠিটা ঠিকই আছে।
চিঠিতে কী লেখা বুড়ন জানে না। জানার কথাও না। সে এটুকুই জানে, তাকে এবং তার মতো পাইকদের একসঙ্গে রাজাবাবুর ছাতার তলায় আসার দরকার খুব। অবশ্য পাইক তো না, সে চুয়াড়! হ্যাঁ, এই নামেই তাকে এবং তার মতো অগুনতি পাইককে দেগেছে লালমুখো সাহেবরা। গেঁয়ো, অসভ্য, অমার্জিত, বর্বরেরা সমানে লড়াই দিচ্ছে ধলা সায়েবদের— এ ‘চুয়াড়ি’ ছাড়া আর কী?
************************************************
সাতকড়ি সান্যালের চায়ের দোকানটার পিছনে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে চিত্ত। কাঁচা নর্দমা থেকে পাঁকের গন্ধ আসছে নাকে, মশায় ছেঁকে ধরেছে পা দুটো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বুকের ভেতর থেকেই যেন পুলিশের বুটের শব্দ আসছে ওর। মুখটা একটু বের করে চিত্ত দেখল, পুলিশ এদিকে আসছে কি না।
গোটা কৃষ্ণনগর শহরটা একটা নিরেট অন্ধকারের গোলক মনে হচ্ছে আজকে, এর মধ্যেও পুলিশের বুটের শব্দ পাতালপুরীর রক্ষকের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছে চিত্তদের।
নিচু হয়ে পায়ে একবার হাত বুলিয়ে নিল চিত্ত। অন্তত সাত-আটটা মশা মারা পড়ল। হাতটা রক্তে চ্যাট চ্যাট করে উঠল ওর। অতনুর মুখটা মনে পড়ে গেল আবার। ওরিয়েন্ট স্টোর্সের কাছে অতনু পড়ে আছে এখনও। ওর পাঞ্জাবিটা রক্তে ভেসে গেছে।
ক্লাসের সেকেন্ড বয় ছিল অতনু, খুব ইচ্ছে ছিল প্রেসিডেন্সিতে পড়বে। একটা গুলি কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে চিত্তর, আর একটা লেগেছে অতনুর পিঠে। ঘুরে তাকানোর সময় পায়নি ও। অতনু পড়ে যাওয়ার পর পুলিশগুলো থেমে গেছিল একটু, সেই ফাঁকে পাঁচিল টপকে পালিয়ে এসেছে চিত্ত। তারপর দৌড়োতে দৌড়োতে সাতকড়ি সান্যালের দোকানের পিছনে এসে লুকিয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে পুলিশ এখানে চলে আসতে পারে।
পকেটে হাত দিল চিত্ত। পিস্তলটা কী ঠান্ডা লাগছে!
“তিনটে গুলি আছে। শালাদের বুকে ভরে দিবি।” পল্লব ওর হাতে দিয়ে বলেছিল। পল্লবকে মারতে মারতে গাড়িতে তুলেছিল পুলিশ।
খিদেয় পেট মুচড়ে উঠছে চিত্তর। মাথার ভেতরটা কেমন ঘুলিয়ে উঠছে খিদেতে। সকাল থেকে কিচ্ছু পেটে পড়েনি ওর। সকালে মিছিল থেকে ফিরে ও দেখেছে, মা আর বড়দির মেয়েটা বারান্দায় বসে আছে চুপ করে।
অঘোরকাকুর থেকে এক শিশি কেরোসিন চেয়ে এনেছিল বাবা, সেই দিয়ে কাল রাতে ভাত ফুটেছে ওদের। আজ সকাল থেকে আবার উপোস।
কুয়োতলায় স্নান করছিল চিত্ত, কুয়োর জল পেটে ঢুকছিল মাথা বেয়ে। মুখটা তেতো লাগছিল খুব।
পল্লব ডাকতে এসেছিল ওকে, “রিলিফ অফিসের পাশে একটা চালের গুদাম দখল হবে, চল।”
কোনওরকমে পাঞ্জাবিটা গলিয়েই ছুটেছিল চিত্ত। মা-বাবা কিচ্ছু বলেনি। জুতোটা পরার সময়ে চিত্ত দেখেছে, বাবার চোখে জল।
********************************************
সরকার কামার পাড়ায় লুটিশ ঝুল্যেছে— কুনও সাঁওতালকে তিরের ফাল, টাঙ্গি, ইসব নাকি বেচা যাবে না। শিকারের লেগে যদি কিনতেই হয়, থানায় গিয়ে লিখিয়ে আনতে লাগে। শুনেই তো হেসে দিছিলাম একচোট। ভয় পেছে শালারা।
...ভয় তো ছিলই উয়াদের। পশ্চিমপাড়ার লখাই বাস্কে ভরবাজারে চাবুক খেল পুলিশের। কী তার দোষ? দারোগার কাছে না লিখিয়েই কামারপাড়া থেকে দুইখানা কুড়াল আর দুইগণ্ডা তির কিনছিল। সে যে ওই দিকে যে জঙ্গল কেটে মহাল গড়ার কাজে লেগেছে, গাছ কাটতে যে ভালো কুড়াল লাগে, আগের কুড়ালখানা শিসউ গাছ ফাঁড়তে গিয়ে ভাঙেছে, জঙ্গলে যে শিয়াল আর হায়নার খুব দাপট, দশজনের মধ্যে পালা করে একজনকে তির-ধনুক হাতে ঝোপঝাড়ে চোখ রাখতে হয়— এত কথা কে শুনবে? আর শুধু কি লখাই? তাকে মাল বেচার দোষে হরি কর্মকারও খেয়েছে দুই ঘা। সঙ্গে নগদ তিন টাকার জরিমানা!
যন্তন্না ছিল নিজেরও মনে, আগুনও। জ্বালা মিটাতে ঠিক করেছিলাম, যে-ই ওই লালমুখো আর তাদের লাল-পাগড়ি খাকি-জামার শিয়ালগুলার সঙ্গে লড়বে, ভিড়ে যাব তার সঙ্গে। গম্ভীরার পালার জন্যি নিমকাঠের মুখোশ ছিল খান-দুই। শিব আর দুর্গার। এবার গণেশের মুখোশ হয়েছে একজোড়া। হুবহু যেন একছাঁচে বানানো। তারই গায়ে তিরের ফাল লুকানোর আট-দশটা করে ছ্যাঁদা। গান গাইতে গাইতে কামারপাড়া যাই। একফাঁকে পেট-খালি মুখোশখানা তাদের হাতে ধরিয়ে তিরের ফলা ভর্তি মুখোশটা ঝোলায় ভরে নিই।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.