বাংলার লোকশিল্প : শিল্পী ও শিল্পের সন্ধানে
তিলক পুরকায়স্থ
বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির মানসিকতায় শত শত বছর ধরে অন্ত:সলিলা ফলগু নদীর মতন বয়ে চলেছিল বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, বাংলার লোকশিল্প ও লোক কলার সাধনা। বাঙালি জাতির অনন্যতা, তার জিনগত শিল্পবোধ এবং নান্দনিকতা প্রকাশ পেত কারুশিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে। এই সব লোকশিল্প ছিল চিরায়ত বাংলার নিজস্ব ব্র্যান্ড।
মহেঞ্জোদারো সভ্যতায় যে শিল্প সম্ভার পাওয়া গেছে, বাঁকুড়ার বিকনা গ্রামে বা বর্ধমানের দরিয়াপুরে সেই শিল্প সম্ভার আজকেও নির্মাণ করা হয়। তাকে নিয়ে আমাদের গর্ববোধ করা উচিত।
মানব সভ্যতার বিকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল টেরাকোটা সামগ্রীর। সুমের-ব্যাবিলন-আজটেক সভ্যতার প্রত্নসামগ্রীর মধ্যেও পোড়ামাটির শিল্প সামগ্রী পাওয়া গেছে। আজকেও বাঁকুড়া জেলার তালডাংরা থানার পাঁচমুড়া গ্রামের কুম্ভকার শিল্পীরা কত অসাধারণ সব টেরাকোটার শিল্প সামগ্রী নির্মাণ করে চলেছেন। পাঁচমুড়ার ঘোড়া হচ্ছে ভারতীয় লোক শিল্পের উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি, সেন্ট্রাল কটেজ ইন্ডাস্ট্রিস এমপোরিয়ামের লোগো। স্মরণাতীত কাল থেকে এরকম কত লোকশিল্পের সৃষ্টি ও সাধনা সারা বাংলা জুড়ে হচ্ছে তার শেষ নেই।
বীরভূম জেলার খয়রাশোলের কাছে লোকপুর বা প্রাচীন লক্ষীপুর গ্রামের একটি মাত্র পরিবারের সদস্যরা প্রাণপনে চেষ্টা করে চলেছেন অলংকৃত সেরপাই বা সিউড়ি বোলকে বাঁচিয়ে রাখতে, আমরা কজন তার খোঁজ রাখি। স্ট্রিং পাপেট ও রড পাপেট শৈলীর পুতুলনাচের বাইরেও আছে একটি আশ্চর্য সুন্দর শৈলীর পুতুলনাচ আমাদের বাংলাতেই । সেটি হচ্ছে সাঁওতালি পুতুলনাচ বা চদরবদর। এর আরেকটি নাম ‘চাদর বাঁধনি’। চোখে দেখা দূরের কথা, কতজন এই লোকশিল্পটির নাম শুনেছেন সন্দেহ আছে। সমস্ত লোকায়ত পুতুলনাচের শৈলী থেকে সাঁওতালি পুতুলনাচ বা চদরবদর সম্পূর্ণ আলাদা। শিল্প ও বিজ্ঞানের মিশেলে পরিবেশিত হয় এই কাঠপুতুলের নাচ। সারা বিশ্বের কথা বলতে পারবো না। সারা ভারতবর্ষে বহু রাজ্যের বিখ্যাত সব কাঠপুতুলের নাচ দেখেছি, কিন্তু কাঠের লিভারের সাহায্যে লিভার ঠেলে ঠেলে পুতুলনাচ দেখাবার জটিল প্রযুক্তির কৌশল আর কোন নাচে দেখা মেলেনি।
৮০ র দশক অবধি যে কোন বাঙালিই গর্ব বোধ করতেন, বঙ্গ সংস্কৃতির আবহমান ঐতিহ্য নিয়ে। কিন্তু হঠাৎ করে কি হয়ে গেল, বিশ্বায়নের দাপটে আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের চিরকালীন সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ, হারিয়ে গেল জীবন থেকে মনন ও নান্দনিকতার চর্চা। বাঙালি জাতিসত্ত্বা কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমরা হয়ে গেলাম এক আন্তর্জাতিক হাঁসজারু প্রজাতি ।
বিশ্বায়ন অবশ্যই দরকার, কিন্তু কখনই তার জন্য নিজের শিকড়কে ভুলে যাওয়া কাম্য হতে পারেনা।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.