কাঁহা গেলে তোমা পাই
জয়দেব মুখোপাধ্যায়
সংযোজন :
শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্ধান রহস্য-১
পুরীর স্বর্গদ্বারের মোড়ে, যেখানে শ্রীচৈতন্যদেবের মূর্তিটা রয়েছে সেখান দিয়েই সমুদ্রের বীচে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েই চৈতন্যমূর্তি সংলগ্ন প্রথম অস্থায়ী দোকানদারকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে মূর্তিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কার মূর্তি? মলিন পোশাকের ওডিয়া দোকানি অবজ্ঞার সাথে বললেন, 'চৈতন্যের'। আমার পরের প্রশ্ন, "এখানে কার মাহাত্মা বেশি, জগন্নাথদেব মন্দিরের না চৈতন্যদেবের?” প্রশ্নটি শুনে ভদ্রলোক একটু রুষ্ট হলেন মনে হল, আমার উদ্দেশ্য সফল হল। উল্টে উনি প্রশ্ন করলেন, 'আপনি কী কারণে এখানে এসেছেন?' অর্থাৎ বোঝাতে চাইলেন জগন্নাথদেবের মাহাত্ম্যের কারণেই আমি পুরী এসেছি। এরপর আর আমার সাথে কথা বলার আগ্রহ দেখান নি। আমার মনে হল, ওনার এই আপাত নিরীহ প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে শ্রীচৈতন্যদেবের মৃত্যু রহস্যের উপাখ্যান।
স্বর্গদ্বারের ডানদিকে একটু এগিয়েই রাস্তাটা দুটোভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে, বাঁদিকের রাস্তাটায় প্রথমে শ্মশান তারপর এগিয়ে গিয়েছে পুরীর বাজারের দিকে। শ্মশান থেকে একটু এগোলেই মীনাক্ষি হোটেল, তার পাশেই ট্রাভেলিং এজেন্ট কার্তিক দাশের অফিস। তার পাশেই একটা সরু গলি সমুদ্রের দিকে চলে গিয়েছে। গলির শেষে আনন্দময়ীর বিশাল আশ্রমবাড়ি। দরজা দিয়ে ঢুকেই উঠোন, উঠোনের বাঁদিকে বিশাল আশ্রমবাড়ি আর ডানদিকে দুটো ঘর, বারান্দা, চাতাল। চাতালের একদিকে দুটো অগভীর চৌবাচ্চা। ঐ চৌবাচ্চার মধ্যেই গবেষক ডক্টর জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের দেহটা পড়েছিল। মাথাটা ভেতরে, পা বাইরে। ভেতরে আধ চৌবাচ্চা জল, মাথাটা পুরো জলে ডোবা ছিল, হাতদুটো পিছন দিকে দড়ি দিয়ে বাঁধা, ঘরের দরজা খোলা, খাটের তলায় মেঝেতে ডক্টর জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মা বিমলা মুখোপাধ্যায় উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছিল। ঘরের মধ্যে ঘুমের ওষুধের ছেঁড়া রাংতা, ইংরেজিতে লেখা দুটো সুইসাইড নোট আর প্রচুর বই, প্রাচীন পুঁথি-সব লণ্ডভণ্ড করা, বক্তব্য প্রত্যক্ষদর্শীদের।
চৈতন্য মৃত্যুরহস্য গবেষক ডক্টর জয়দেব মুখোপাধ্যায় স্বর্গদ্বার অঞ্চলে তথা পুরীতে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। অনাথ অসহায় বহু মানুষকে তিনি সাহায্য করতেন। পুজোর সময় গরীবদের জামা কাপড় দিতেন, প্রসাদ খাওয়াতেন। প্রতিদিন বহু মানুষ দেখা করতে আসতেন এই মানুষটির সাথে। রাজীব গান্ধীর মতো মানুষকেও ওনার কাছে আসতে দেখা গিয়েছে। এহেন মানুষটিকে যখন দাহ করার জন্য শ্মশানে আনা হয়েছিল, ভয়ে কেউ আসেনি, পুলিশ দাহ করে দিয়ে চলে গেল আর ঘরের সব বইপত্র, প্রাচীন পুঁথি নিয়ে কোথায় চলে গেল, কে জানে। বক্তব্য প্রত্যক্ষদর্শীদের। কাছের মানুষদের তিনি বলেছিলেন, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শেষ জীবনটা বড় কষ্টের, যারা কষ্ট দিয়েছিলেন, তাদের নাম ফাঁস করে দেব। সব পুঁথি, প্রমাণ পেয়েছি।
১৫১০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীচৈতন্যদেব পুরীতে আসেন আর ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুন মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ওনার অন্তর্ধান ঘটে। জীবনের শেষ ১৮ বছর পুরীতেই ছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্ধান রহস্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে বারবার ঘুরে ফিরে চলে আসে গবেষক ডক্টর জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু রহস্যের কথা। যে মানুষটা গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের মৃত্যু রহস্যের সমাধানের জন্য। ৪৬২ বছর বাদে শ্রীচৈতন্যদেবের মৃত্যুরহস্যের অনুসন্ধানে নেমে যখন প্রায় প্রমাণ করতে চলেছেন শ্রীচৈতন্যকে কিভাবে কারা খুন করেছিল এবং দেহ কোথায় পুঁতে রেখেছিল, ঠিক তখনই (১৯৯৫ সালের ১৭ই এপ্রিল) রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হল সত্যান্বেষী ডক্টর জয়দেব মুখোপাধ্যয়ের। আজ ২৮ বছর বাদেও প্রয়াত জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু রহস্যাবৃত। স্থানীয় মানুষ যাকে সরাসরি খুন বলে সন্দেহজনক ব্যক্তির শাস্তি চায়, সরকারি খাতায় তাকেই আত্মহত্যা বলে দেখানো হয়েছে।
প্রয়াত চৈতন্য গবেষক জয়দেব মুখোপাধ্যায় উপন্যাসের আঙ্গিকে লেখা চৈতন্যের সমাধির খোঁজে একটি তদন্তমূলক গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের নাম 'কাঁহা গেলে তোমা পাই'। সেখানে তিনি লিখেছেন, পুরীর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কর্মসচিব স্বামী অভিনবানন্দজী এক পত্র লিখে তাকে জানিয়েছেন, তার সুনিশ্চিত ধারণা, মহাপ্রভুর দেহটিকে মণিকোঠার রত্নবেদীর নিম্নেই সমাহিত করা হয়েছিল। একই কথা বলেছেন ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন তার 'Chaitanya and his age' গ্রন্থে, যিনি প্রথম স্পষ্ট করে বলেছিলেন, পুরীর মন্দিরের ভেতরে শ্রীচৈতন্যকে খুন করে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুন চৈতন্যদেব গান গাইতে গাইতে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকেছিলেন। সেই প্রথম আর শেষ মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল, (কোভিড পিরিয়ড বাদে) তারপর চৈতন্যকে আর পাওয়া যায় না। এই ব্যাপারে অধিকাংশ চরিতকার একমত। শ্রীচৈতন্যের মৃত্যু রহস্যের উদঘাটনের মাত্র দশদিন মতো বাকী ছিল, এই দশদিন আর শেষ হয়নি, 'কাঁহা গেলে তোমা পাই' উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের ঘরে পৌঁছনোর আগেই ডক্টর জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের রহস্যজনক মৃত্যু হয়।
শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য সম্পর্কে কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে-
১। পুরী নীলাচলে কৃষ্ণ নাম জপতে জপতে সমুদ্রের দিকে হেঁটে চলে যান এবং সমুদ্রে বিলীন হয়ে যান।
২। জগন্নাথ মূর্তির সঙ্গে শ্রীচৈতন্য লীন হয়ে গিয়েছিলেন।
৩। সংকীর্তনে বের হয়ে পথে তাঁর পায়ে ইটের আঘাত লেগেছিল তার ফলে সেপ্টিসেমিয়া এবং মৃত্যু। কেউ কেউ বলেন পায়ে কাঠি ঢুকে সেপ্টিসেমিয়া এবং মৃত্যু।
প্রশ্ন হচ্ছে, মৃত্যু হলে দেহ কোথায় গেল? ২০০০ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার পক্ষ থেকে কয়েকজন প্রত্নতাত্ত্বিক জগন্নাথ মন্দিরের সংরক্ষণ করার সময় মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে খুঁজে পায় প্রায় ছয় ফুটের এক কঙ্কাল। পরীক্ষা করে জানা গেল, মৃত ব্যক্তি ছিলেন অত্যন্ত দীর্ঘাঙ্গী এবং তার মৃত্যু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিচার করে বেশিরভাগ মানুষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, এই কঙ্কালটি বাংলার ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেবের। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কলিঙ্গের রাজা প্রতাপরুদ্র শ্রীচৈতন্যকে দেবতাজ্ঞানে মান্য করতেন। শ্রীচৈতন্য রাজাকে অনুরোধ করেন, নিচু জাতের মানুষদের বিভিন্ন ক্ষমতা অর্পণ করার জন্য। মন্দিরে ঢোকা, রথের দড়িটানাসহ বিভিন্ন বিষয়ে, এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে পাণ্ডারা। শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে রাজা ক্রমশ ধার্মিক যুদ্ধ বিরোধী হয়ে উঠছিলেন। যুদ্ধের অস্ত্র বিক্রেতারাও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে গুপ্ত হত্যার সাথে যুক্ত হয়ে ওঠে বলে মনে করা হয়।
পুরীতে প্রথম এলাম দীঘা, শঙ্করপুর একাধিকবার গেলেও সমুদ্র সেইভাবে কখনোই টানেনি। পুরীতে এসে কেন জানিনা, সমস্ত দিনগুলোই আচ্ছন্ন থাকলাম চৈতন্যদেবের মৃত্যু রহস্য নিয়ে। এই বিষয়ে অভিজ্ঞ বন্ধুদের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।
তথ্যসূত্র : আজকাল পত্রিকায় (৩০-০৪-১৯৯৫) অরূপ বসুর আর্টিকেল।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি