গল্প সমগ্র শিব্রাম
শিবরাম চক্রবর্তী
পাঠকদের উদ্দেশ্যে----
শব্দের জাদুকর, শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে পাশাপাশি শব্দগুলি মিলে মিশে একটি শব্দের যে কতরকমের অর্থ হয় তা আমাদের শিবরাম দেখালেন। ছোটদের লেখক হিসাবেই তাঁর পরিচয়। তিনি বলেছেন "..... আমার লেখায় ছোটদের কখনই আমি ছোট বলে ধরিনি, অবোধ শিশু বলে গন্য করিনি কখনো। আমার সমকক্ষ বলেই ধরেছি তাদের। বয়স্ক বন্ধুর মতন বিবেচনা করেছি। বড় হবার উপদেশ নয় বড়ত্বের স্বাদ পেয়েছে তাঁরা আমার লেখায়".....।
শিবরামের আগে যাঁরা বাংলাসাহিত্যে ছোটদের জন্য লিখেছেন তাঁরা যে ধরণের গল্প লিখেছেন শিবরাম তার উল্টো করেছেন। নামকরণের মধ্যথেকেই তিনি বিশেষত্ব দেবার চেষ্টা করেছেন। হাতির সঙ্গে হাতাহাতি করাতো সম্ভব নয় যদিও ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করা যেতে পারে।
ছোটদের জন্য কলমধরার পাশাপাশি তিনি সৃষ্টি করেছেন দুই অমর চরিত্র। স্বাভাবিকভাবে গোড়ার দিকে হওয়ায় হর্ষবর্ধন এবং গোবর্ধন চরিত্র দুটিকে পাঠকের কাছে পরিচিত করানোর দায়ও ছিল। 'কলকাতায় এলেন হর্ষবর্ধন' ও 'হর্ষবর্ধনের কলকাতা জয়' বই দুটিতে গল্পের নির্বাচনও চরিত্রদুটির ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
কলকাতায় আসার পরে কলকাতা চেনা চরিত্র হিসেবে গল্পগুলির নামভূমিকা তৈরী করেছি। শুধুমাত্র কয়েকটি গল্পের ক্ষেত্রে কলকাতা থেকে গল্প চলে গেছে অন্যত্র। কলকাতা জয় সেই অর্থে কলকাতার পাঠকের মন জয়কে চিহ্নিত করছে।
প্রতিটি গল্পেই দুই মুখ্য চরিত্র হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন উপস্থিত। কখনো কখনো শিবরাম উপস্থিত। গল্পগুলির গঠনশৈলীই একত্রিত হয়ে সঙ্কলন গ্রন্থে যাবার একমাত্র সাধারণ সূত্র। যখন যেখানে যে সময়ই পড়া যাক না কেন কথার মার প্যাঁচে উদ্ভূত রস সবসময়েই মজুত।
প্রশ্ন হচ্ছে শিবরাম হঠাৎ কেন এমন একজোড়া চরিত্র সৃষ্টি করতে গেলেন। এ সম্বন্ধে শিবরামের নিজের বক্তব্যই প্রথমে শোনা ভাল- "আমার হাসির গল্প লেখার গোড়ায় মহাত্মা মার্কটোয়েন তাঁর কাছেই আমি ঋণী। কি করে জানিনে, তাঁর ইনোসেন্স অ্যাব্রড বইয়ের কয়েকটি ছেঁড়াপাতা আমার হাতে উড়ে এসে পড়েছিল-গোড়াকার পাতা কটাই। তাই থেকেই আমি হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধনের প্রেরনা পাই। তারপরে অবিশ্যি লরেল হার্ডির অনুপ্রেরনাও ছিল বইকি! জগদ্বিখ্যাত ওই দুটি চরিত্রের আদলে তাদের বোকামির বহরের এসেছিলাম তাঁদের মহত্বের কিছু কিছু মিশিয়ে আমার এই দুটি ভাই। আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই জীবনে আর যে সব মহানুভব চরিত্রের সংস্পর্শে কিশোর বয়সেই দেশবন্ধুর থেকে শুরু করে বিধানচন্দ্র পর্যন্ত সব মহাপুরুষদের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল। দেখেছি তারা সবাই অল্পবিস্তর পুন্যশ্লোক বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সগোত্র। বদান্যতার পরাকাষ্ঠা, সৎ বদ্ নির্বিচারে অপরো সাহায্যে অর্থভার মুক্ত হয়ে নিজেদের ধন্যজ্ঞান করেন। অতএব, আমার এঁরা একেবারেই কাল্পনিক নন, আশেপাশেই রয়েছেন দেখা যায় এঁদের এখনো"।
বর্তমান আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা প্রশাসনের প্রতি আমাদের ক্রমশ হতাশ করে তুলছে। দুটি বিশেষকরে 'কালান্তক লালফিতে' এবং 'পিগ মানে শুয়োরছানা' গল্পে এই দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে শিবরাম খুব মজা করেছেন। এই দীর্ঘসূত্রিতা যে হঠাৎ গজিয়েছে তা নয়। শিবরামের গল্পের পটভূমি ইংরেজ আমল হলেও আড়ালে আমরা বর্তমানকেও লক্ষ করতে পারি। এটাই বিশেষত্ব।
স্কুলের মাস্টারমশাইদের নিয়ে ঠাট্টা মসকরা সমস্ত মানুষদের ছোটবেলার স্মৃতি। কতধরনের মাস্টার হতে পারে এবং তারা কত ধরনের মাস্টারী করতে পারে তা নিয়ে শিবরাম অনেকগুলি গল্প লিখেছেন। বেশির ভাগ গল্পেই দেখা গেছে শিবরাম মাস্টারের বিপক্ষে ছাত্রদের জয়ী করেছেন।
নির্ভেজাল, অমলিন হাসির সৃষ্টি সহজকথা নয়। শুধুমাত্র আড়চোখে দেখার জন্য তা হয়েছে তা নয়। শিবরামের বৈশিষ্ট্য তিনি একটি গল্পকেই বাস্তবের পটভূমিতে গড়ে তুলেছেন। তাঁর জন্য আমাদের পরিচিত জানা জগতকে মাঝে মাঝেই মনে করায় এবং বাস্তবে যা ঘটেনা তা তারগল্পে ঘটে বলেই এত হাসির জন্ম হয়। শিবরাম ঘটনা ঘটান কেননা তাঁর মধ্যে দিয়েই তিনি আলাদাভাবে তার পাঠককে বিশেষ করে ছোটদের সচেতন করার চেষ্টা করেন। হাসির আড়ালে বেদনাকে তিনি সযত্নে লুকিয়ে রাখেন মহৎ শিল্পীর মত।
'কিশোর গল্প সমগ্র' প্রথম খন্ডটিতে পাঠকরা শিবরামের মহত্বের ছোঁয়া পাবেন। আশাকরি সব বয়সের পাঠকদের কাছে এই বই ভীষণভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
-----অরুণ কুমার রায়
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি