বই - কৃষ্ণ থেকে কৃষ্ণকলি : রবীন্দ্রসংগীতে কীর্তনাঙ্গ ধারা-উপধারার সমীকরণ
লেখিকা - ড. দেবশ্রী বসু
বিভিন্ন গ্রন্থে এবং তথ্যে রবীন্দ্রনাথের গানে কীর্তনের প্রভাবের একাধিপত্যের উল্লেখ আছে। কিন্তু বেহাগ, খাম্বাজ, পিলু, ভৈরবী ও কীর্তন---- এই পাঁচটি নাম সমপর্যায়ের নয়। কীর্তন কোনো রাগরূপের সঙ্গে তুলনীয় নয়। কীর্তন একটা musical tradition, একটি সাঙ্গীতিক ধারা, যা নদীর মতো একটি মূল স্রোত থেকে নানা শাখার স্রোতে বিস্তারিত হয়ে গেছে। কীর্তনের অঙ্গ, অংশ, তাল প্রকরণ, অলংকরণ বিভিন্নভাবে রবীন্দ্রনাথের অজস্র গীতরচনাকে প্রভাবিত করেছে। যে গীতরচনার মূল কাঠামোটি কীর্তনের নয়, হয়তো বা শাস্ত্রীয় রাগাশ্রিত। যেমন ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ গানের একটি স্তবক, ‘এমনি করে কালো কাজল মেঘ’ হয়তো বা কোনো নির্দিষ্ট রাগরূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাঁর পরেই ‘শ্রাবন রজনীতে’ এই অংশ কীর্তনের একটি সুনির্দিষ্ট প্রবণতার মধ্যে মিশে গেল। এই মিশ্রণ এত সূক্ষ্ম, এত স্বাভাবিক, এত সরল, অথচ এত নান্দনিক, যা কোনো মহাপ্রতিভাশালী স্রষ্টা ছাড়া সম্ভব নয়।
কীর্তনের একাত্মতায় কবির কাছে কীর্তনের আবির্ভাবও প্রায় ঈশ্বরের মতন এমন অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। তিনি নিজেই জানেন না গানে সুর দিতে দিতে রাগের প্রয়োগে, সুরের চলনে কখন কীর্তনের সুর এসে যায়, তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না। তা অচেনা কুসুমগন্ধের মতো, গোপন আনন্দের মতো তাঁর গানকে আচ্ছন্ন করে তোলে। এমনকী আঘাতে, শোকে, কঠিন বেদনায় তাঁর সুর কীর্তনের সুরে বিগলিত-বিলীন হয়। তাঁর গানে স্তরে স্তরে, স্তবকে স্তবকে, চরণে, পদক্ষেপে এই কীর্তন প্রভাব সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করে না ‘আমি গরানহাটি কীর্তন’, কিংবা এই সুরটি ‘ঢপ কীর্তন’-এর সুর। তা এমনই রাবীন্দ্রিক হয়ে দেখা দেয় যে কবি নিজের অজান্তেই যেন কীর্তনীয়া হয়ে যান।
রবীন্দ্রনাথের বিপুল সংগীত সম্ভারে কীর্তনের এই সম্পূর্ণ ও আংশিক প্রভাব নিয়ে আজ পর্যন্ত সেভাবে কোনো বিস্তৃত আলোচনা হয়নি। বিশেষ করে গরানহাটি কীর্তন, ঢপকীর্তন, মনোহরশাহি কীর্তন, বাউলাঙ্গ কীর্তন, পালা কীর্তন, লীলা কীর্তনের বিচিত্র পটভূমিতেই রবীন্দ্রনাথের সংগীতসৃষ্টির পরিমাপ করা উচিত, যা তেমনভাবে হয়নি। কীর্তনের গীতরীতি কয়েক শতাব্দী ব্যাপ্ত করে এত বিচিত্রভাবে বিবর্তিত হয়েছে, সে সম্পর্কে ধারণা না থাকলে রবীন্দ্রনাথের গানে কীর্তনের প্রভাব শনাক্ত করা দুরূহ হয়ে পড়ে।
কীর্তন, কীর্তনের সুর ও স্বর বিন্যাসের ছোট ছোট প্রণালীকে কবি এমন গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন যে, তাঁর শত শত গানে, শিরায় শোণিতে জীবন-স্পন্দনে অনুসৃত হয়ে গেছে। এই গ্রন্থে কবির শত শত গান ধরে ধরে কীর্তনের লক্ষণগুলি শনাক্ত, চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গানের মূল কাঠামো ভেঙে, তছনছ করে স্ট্রাকচারাল অ্যানালিসিস বা গঠনগত বিশ্লেষণের দ্বারা কীর্তনকে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক আত্মস্থ করার স্বরলিপি বা সুরলিপি এই গ্রন্থে প্রথম করা হল।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি