মরিচঝাঁপি : ছিন্ন দেশ, ছিন্ন ইতিহাস
সম্পাদনা : মধুময় পাল
দেশভাগের অপরিনামদর্শিতার গর্ভের সন্তান দণ্ডকারণ্য, আর দণ্ডকারণ্যের সীমাহীন অন্যায় আর অবিচারের গর্ভে জন্ম মরিচঝাঁপির। দেশভাগ যদি হয় অখণ্ড ভারতের রাজনীতিবিদদের পাপ, মরিচঝাঁপি বাংলার বাম জমানার আদি পাপ। একটা কথা বলে রাখা দরকার, প্রাক্ বাম জমানার উদ্বাস্তুনীতিতে বিবেকের স্পর্শ কম ছিল। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে সেই সময়ের শাসকশ্রেণির হৃদয়হীনতা হাজার হাজার মানুষকে মনুষ্যেতর বাঁচার দিকে ঠেলে দেয়। তাড়িয়ে পাঠানো হয় আন্দামানে, দণ্ডকারণ্যে। এর কারণ, কংগ্রেস প্রশাসনে এলিট আধিপত্য। তাই, পরবর্তী সময়ে মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের দুর্দশায় সেই এলিট প্রতিনিধিদের উদ্বেগ ও কাতরতা স্ট্র্যাটেজিক মায়াকান্না বলে বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু বিমর্ষ হতে হয় এটা বুঝে যে, বাম শাসনেও সেই এলিট বা 'ভদ্রলোক'দের আধিপত্যই আর একটা পাপ ঘটাতে পারল। ক্ষমতার হাত বদলে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায় না, বোঝা গেল।
নৈঃশব্দ্যের অস্ত্রে ছিন্ন হয়ে ছিল তিরিশ বছর আগের সেই ইতিহাস। পুরনো লেখা তুলে এনে, নতুন লেখা দিয়ে ছিন্ন দশা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা গেল। সব কণ্ঠস্বর নিয়ে শোনা গেল দেশহারাদের স্বপ্ন আর স্বপ্ননাশের বৃত্তান্ত। যা একই সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতারও বৃত্তান্ত।
ওঁরা এসেছিলেন, অন্তত দেড় লাখ, স্বদেশের জলমাটিহাওয়ার টানে, এক স্বরাজের ঘোরে। ওঁরা বাঙালি শরণার্থী। দেশভাগের দেশভিখারি। এসেছিলেন দণ্ডকারণ্যের অর্থাভাব অর্ধাহার, অন্যায় অবিচার, অকাল রুগ্নতা অকাল মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে, নিদেনপক্ষে বাংলার বাতাসে শেষ নিশ্বাস ফেলতে। ওঁদের আসতে বলা হয়েছিল। ওঁরা আহূত, আমন্ত্রিত। সুন্দরবনের প্রান্তিক দুর্গম দ্বীপ মরিচঝাঁপিতে ওঁরা নিজেদের শ্রমে বাঁধছিলেন ঘর, গড়ছিলেন সমাজ, রচনা করছিলেন উপার্জনের ক্ষেত্র। ক্রমে হয়ে উঠছিলেন দেশবাসী। কিন্তু ওঁদের থাকতে দেওয়া হল না। উৎখাত করা হল। খেদানো হল। সরকারি বয়ানে অবশ্য ওঁরা 'সাগ্রহে বিদায় নিয়েছেন'। 'সাগ্রহে বিদায়ে' ওঁদের অনেকে জখম হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, ধরাধাম থেকে সাগ্রহে চিরবিদায়ও নিয়েছেন! উৎখাত করলেন কারা? যাঁরা ওঁদের ডেকে এসেছিলেন। যাঁরা ওঁদের নিয়ে বাংলায় লম্বা রাজনীতি করেছেন ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে পর্যন্ত। সরকার তার কাজ করেছে, বাংলার মানুষ কী করেছিল? দেশহারা বাঙালির আকাঙ্ক্ষাকে স্পষ্টত অনাদর অবহেলা দেখিয়েছিল দেশাভিমানী বাঙালি। কেন অনাদর? কারণ ওঁরা প্রান্তজন, ছোটলোক। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় 'ঘুঁটেকুডুনির ছানা'। 'এ-দুয়োরে যায়: দূর-দূর!/ ও-দুয়োরে যায়: ছেই ছেই'।