পিনডিদা সমগ্র
মুশকিল হয়েছে আমার। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার এখনো দেড় মাস বাকি। আমার মতে দেড় মাস সময় সমুদ্রের মতো অঢেল সময়। দেড় মাস ছেড়ে দেড় দিন বাদে পরীক্ষা হলেও আমার দিক থেকে কোনো উদ্বেগের কারণ নেই। স্কুলে সব পরীক্ষাতেই বরাবর ফার্স্ট হয়ে এসেছি। সেকেন্ড বয় আমার থেকে সব সময়েই কম করে একশো নম্বর পিছনে। সব কটা পেপারে এক জিনিস। বারবার রিভিশন করতে করতে আর লিখতে লিখতে আমার মুখে ফেনা আর হাতে প্যারালিসিস হওয়ার দাখিল। তবু বাড়িতে এমন অবস্থা আমার যে আমি যেন একটা ফেল করা ছাত্র। বাবা আমাকে ডেকে গম্ভীর মুখে বলে, সোনা, এখন তুমি হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছ মানেই অ্যাডাল্ট হতে যাচ্ছ। পরীক্ষা পর্যন্ত আড্ডা-টাড্ডা দেওয়া আর খেলার স্বপ্ন দেখা ছাড়ো - মনে রেখো এটা তোমার লাইফের টারনিং পয়েন্ট। এ-সময় আপাত-আনন্দ বড় করে দেখলে ঠকবে। অনেক দিন ধরেই লক্ষ্য করছি, আমার বাবা খুব সিরিয়াস হলেই আমাকে তুই ছেড়ে তুমি করে বলে।
বিকেলেও একটু বেরুবার উপক্রম করলেও মায়ের যেন চোর-ধরা মুখ। -অ্যাঁ? সোনা! কাল বাদে পরশু তোর পরীক্ষা আর তুই হাওয়া খেতে বেরুচ্ছিস?
অগত্যা ও-ঘরে বাবাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে হয়, সকালে পড়েছি, দুপুরে পড়েছি, মাঝে বিকেলেও একটু বেরুবো না? তোমরা কি পরীক্ষা-পরীক্ষা করে আমার মাথাটা খারাপ করে দেবে? আচ্ছা, বাবাকেই জিজ্ঞেস করে এসো, এত পড়ার পরে মাথাটা একটু খালি করার জন্যেও দুই-এক মাইল হেঁটে আসা উচিত কি না-হেঁটে না এলে রাতে আবার পড়লে বসতে স্বাস্থ্যের পক্ষে সেটা ভালো কি মন্দ। যাও জিজ্ঞেস করে এসো, তাতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে না, তা হলে এক্ষুনি আমি পড়তে বসে যাচ্ছি। মা তবু বুঝতে চায় না, বলে হাঁটতে হয়, বেড়াতে হয়, বাড়ির ছাদে বেড়া না।
ও-ঘর থেকে আমার বর্ধমানের নামী ডাক্তার বাবার গলা শোনা যায়, ওকে যেতে দাও। তার পরের কথাগুলো আমার উদ্দেশে, হাঁটতে বেরিয়ে আবার আড্ডা দিতে বসিস না সোনা-হনহন করে দু-আড়াই মাইল হেঁটে চলে আসবি। আসা-যাওয়ায় চার বা পাঁচ মাইল হাঁটতে বেশি হলে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট লাগতে পারে। বাড়ি ফিরে তারপর দশ মিনিট বিশ্রাম, অল্প স্নান আর এক গেলাস দুধ খেয়ে বই নিয়ে বসবি।
ডাক্তার বাবার প্রেসক্রিপশন মায়ের খুব পছন্দ হয় না। কারণ, মায়ের সন্দেহ, হাঁটার বদলে আমি বন্ধুদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিই। সন্দেহটা শতকরা একশো ভাগই যথার্থ। আর মা-ই কেবল জানে চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিটের জায়গায় আমি দেড় ঘন্টা না কাটিয়ে বাড়ি ফিরি না।
ঠাকুমা, যে কিছুই বোঝে না, আর একমাত্র নাতিকে সব আপদ থেকে যার বাঁচানোর চিন্তা-বেরুতে দেখলে সে-ও ইদানীং রা কাটে সোনামণি, তুই চললি কোথায়, তোর না হাই-সেকেন পরীক্ষা- লক্ষ্মীদাদা, এ দুটো দিন পড় মন দিয়ে। ভালো পাস করলে তোকে আমি
একটা আস্ত আমসত্ত্ব দেব! জবাবে বুড়িকে আমার ভেঙচি কাটতে ইচ্ছে করে। ঠাকুমার ধারণা, হাই-সেকেন পাস করলেই আমি একেবারে বিদ্যের জাহাজ হয়ে যাব।
আর, যে মাস্টারমশাই আমাকে বাড়িতে পড়ায়, যে আমার বিদ্যের নাড়িনক্ষত্র জানে আর যার কথা বাবা বেদবাক্য ভাবে তারও এক রা। উঠতে বসতে বলে, সোনা, ডোন্ট ওয়েস্ট প্রেশাস টাইম- তুমি এখন যে-রকম খাঁটি বীজ বুনবে, ভবিষ্যৎ জীবনে সেই রকমই ফসল পাবে।
শুনে শুনে আমার কান ঝালাপালা।
ওদিকে মাঠের দলের সক্কলে ঠাট্টা করে। চটপটি বলে, পরীক্ষা আমরা আর কী দিচ্ছি, পরীক্ষা দিচ্ছে কেবল সোনা। কোনো পেপারে নব্বুই থেকে উননব্বুই হলেই দিন আর রাতের মতো তফাত!
কার্তিক বলে, আমার তো থার্ড ডিভিশন থেকে সেকেন্ড ডিভিশন হলেই দাদারা জিজ্ঞেস করবে টুকলিফাই করেছি কি না। সংস্কৃত-বিশারদ কেবলু ঘুরিয়ে ঠাট্টা করল, সোনা কি আর আমাদের মতো, ওরে আগে মেহনতং পরে সুখং-আমরা হলাম গিয়ে অল্প জলস্য মৎসঃ বেশি ফড়ফড়ান্তি।
এমনকি হাবুল হোঁতকা যার জন্য এই সমস্যা, বাগে পেয়ে সে পর্যন্ত টিপ্পনী কাটতে ছাড়ল না। বলল, সোনার দোষ কী, স্কলারশিপ মিস করলে সোনা পেতল হয়ে যাবে না? না রে সোনা তুই। থাক, আমরা কজনে বেরিয়ে পড়ি- কি বলো পিন্ডিদা।
পিন্ডিদা রত্নটি কে বুঝতেই পারছ। হ্যাঁ, সেই প্রদীপনারায়ণ দত্ত, ব্রেজিলের বাছাই এগারো জনের ফুটবল চূড়ামণি পি.এন. ডি.- যার পায়ে বল পড়লেই অনুরাগীদের আকাশ-ফাটানো চিৎকারে আর উল্লাসে যে পি.এন. ডি. থেকে পিন্ডি হয়ে বসেছিল- আর অসময়ে হাঁটুর মালাইচাকি সরে যাওয়ায় যে সেখানকার লক্ষ লক্ষ ফ্যানদের চোখের জলে ভাসিয়ে আর তাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে এসে এই বর্ধমান বাবুগঞ্জের মাঠের আড্ডায় আমাদের লিডার হয়ে বসেছে-সেই পিন্ডি মানে পিন্ডিদা। সবজান্তা, সর্ব বিষয়ে অভিজ্ঞ আমাদের দলের মুকুটমণি পিন্ডিদা।
পিন্ডিদা সেদিনও এইসব ঠাট্টার সময় তার উচু ঢিবির সামনে বসে ভুরু কুঁচকে আকাশ দেখছিল। সেদিকে চেয়েই গম্ভীর মন্তব্য করল, অল ওয়ার্ক অ্যান্ড নো প্লে মেকস স্নাক এ ডাল বয়। হাবুলের প্রস্তাবের জবাবে চটপটি চিড়বিড় করে উঠল, সোনা না যেতে পারলে প্রোগ্রাম বন্ধ! তোর ওই লাশ সাত মাইল পথ টানবে কে শুনি?
হাবুল অমনি রুখে উঠল, দ্যাখ চটপটি, আমার শরীরের ওপর নজর লাগিয়ে কথা বলবি না- পিন্ডিদা সামনে না থাকলে তোর মুন্ডুটা এই মাঠে ঘষে পটপটি বানিয়ে ছাড়তাম।
আমি না গেলে চটপটি বেচারা প্রোগ্রাম বন্ধ করতে চাইতেই পারে। কারণ, ছজনের মধ্যে চারজনের চারটে সাইকেল আছে-আমার, কার্তিকের, চটপটির আর কেবলুর। তার মধ্যে কেবলুর নতুন কেনা পুরনো সাইকেলের এমনি ঝরঝরে দশা যে একলা কেবলুকে নিয়ে ওটা আট মাইল পথ ভেঙে ডেসটিনেশনে পৌছুতে পারবে কি না সন্দেহ। তার ওপর সকলের মধ্যে কেবলুই সব থেকে কমজোরি। কাজেই ওর সাইকেলে আর কারো ওঠার প্রশ্ন ওঠে না। আমি না গেলে বাকি রইল দুটো সাইকেল। তার মধ্যে পিন্ডিদা বরাবরই কার্তিকের পিছনে চড়ে অভ্যস্ত। সাধারণত আমি থাকলে হেবো হোঁতকার লাশ আমি আর চটপটি পালা করে টানি। এর মধ্যে আমি না গেলে চটপটির একাই ওকে টানতে হবে। সেই জন্যেই আমি না গেলে ওরও যেতে আপত্তি।
ব্যাপার আর কিছুই নয়, হাবুল এর মধ্যে কার সঙ্গে গিয়ে আট মাইল দূরের সেই বাদশা মহলে টহল দিয়ে এসেছিল। নামে মহল কিন্তু আসলে বিরাট একটা পোড়ো বাড়ি। তার চারদিকের বিরাট চত্বরের সবই ওই কবরখানার মধ্যেই আবার বিশাল বাগান। আম জাম জামরুল নারকেল গাছ খেজুর গাছ কী নেই! বর্ধমানের সেরা পেয়ারাও ওই বাদশা মহলেই হত। ওখানে পাহারা বসানোর দরকার হয় না। কারণ, ওখানে ঢুকে উৎপাত করবে এমন সাহস ক জনের?
কিন্তু বছরদেড়েক আগে পর্যন্ত বড় দল করে দু-তিন মাস অন্তর এক একবার সেই বাদশা মহলের চত্বরে টু' দিয়েছি। যখনকার যা ফল আশ মিটিয়ে খেয়েছি। কিন্তু রাতে শুয়ে থরথর কাঁপুনি। এই বুঝি কবরের ভূতেরা সব উঠে এসে ঘরের মধ্যেই আমাদের ঘাড় মটকায়। গোরস্থানে গিয়ে উৎপাত করলেও বরদাস্ত করবে এরকম নিরীহ ভূত আছে বলে ভাবতাম না। তাই রাতে শোবার.....
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.