সব গল্পই গরিব রাজামশায়ের
গৌর বৈরাগী
প্রচ্ছদশিল্পী - অভীক কুমার মৈত্র
রাজামশায়ের রাজ্যপাট গেছে। মন্ত্রী-পাত্র-মিত্র-অমাত্যদের বেশিরভাগই রাজসভা ছেড়ে চলে গেলেন মাইনে বাকি থেকে যাওয়ায়। রাজমশাই গরিব, তাই তাঁর হাতিশালে হাতি নেই। আস্তাবলে কুড়িয়ে বাড়িয়ে মুলতানি এক ঘুড়ি। সে মাঝে একটা ডিমও দিয়েছিল। রাজামশাই খামখেয়ালি, জামা পরতে গিয়ে হাতার মধ্যে হাত হারিয়ে ফেলেন। রাজামশাই ভাবুক, কোকিল কেন কু করল, সেটা নিয়ে ভাবেন। রাজামশাই রসিক, তাই মোড়ের মাথার দোকানে বসে আড্ডা শুনতে শুনতে কচুরি আর জিলিপি খেতে তাঁর আটকায় না।
এমন রাজামশাইকে নিয়ে ১৯টা কিশোর গল্প লিখেছেন সাহিত্যিক গৌর বৈরাগী। তাঁর প্রতিটি গল্পে ছবি এঁকে, বইয়ের মলাট এঁকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন অভীক কুমার মৈত্র।
গল্পগুলোর ভাব বোঝাতে একটা গল্পের কিছুটা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। রাজামশায়ের ইচ্ছে হয়েছে তিনি ফরেন ট্যুর করবেন। তাই ডেকেছেন খাস চাকর বিসর্গকে। বিসর্গের চাচি থাকেন ফরেনে। সেখানে সে নিয়ে চলেছে রাজামশাইকে। কিন্তু ফরেন আদতে তাঁর নিজের রাজ্যের মতোই। তাই রাজামশায়ের মন ভরে না। কিন্তু শেষে কী হল? আসুন সামান্য একটু অংশ পড়া যাক।
তখন সূর্য বেশ পশ্চিমে হেলেছে। আকাশের মেঘে লাল আভা। ঝগড়া শোনার পর বাসে চাপা হল। তারপর সেই বড়ো নদী। ছল ছলাৎ ঢেউ স্টিমারের বুটবুট শব্দ। নদী পেরিয়ে এক ভ্যানরিকশায় উঠেছেন রাজামশাই। বসেছেন ভ্যানে পা ঝুলিয়ে, পাশে বিসর্গ। দুপাশে ধানখেত। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোটো নদী। সেই নদীতে হাল বাইছে এক মাঝি। গাছের ডালে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে বসছে সাদা বক। বিসর্গ বলল, “আহা কেমন দৃশ্য দেখেন রাজামশাই।”
“দৃশ্য না ছাই!” রাজামশায়ের গলা থমথমে। “এসব গোকুলপুরে রোজ দেখছি বিসর্গ। এসব দেখে দেখে চোখ পচে গেল আমার। অন্য কিছু দেখব বলেই ফরেন আসা। কিন্তু এখানেও দেখছি…”
এবার হো হো করে হাসল বিসর্গ। বিশ্বাস করেন স্যার, “এটাই ফরেন। এই দেশটার নাম বাংলাদেশ।”
“তুমি হাসালে বিসর্গ।” বলে এবার নিজেও বেশ লম্বা করে হাসলেন রাজামশাই। ঢং ঢং করতে করতে ভ্যান যাচ্ছে। দুপাশে সবুজ ধানখেত। ধানগাছে দুধ এসেছে। সেই দুধের গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়। গন্ধে খুব সোয়াদ। এসব দেখতে দেখতে বেশ ঘুম এসে গেল রাজামশায়ের।
আসলে চমকে যাওয়ার মতো দেখার কিছু নেই। একঘেয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতে ভ্যানের ঝাঁকুনিতে চোখের পাতা এক করে ফেলেছেন। কখন সন্ধে নেমেছে। কখন ঘরে ঘরে সাঁঝবাতি জ্বলে উঠেছে খেয়াল করেননি। খেয়াল হল বিসর্গের ডাকাডাকিতে।
চোখ মেলতেই দেখলেন সামনে সেই আদ্যিকালের পুরোনো আস্ত চাঁদটা। সোনালি রঙের আলো পাঠাচ্ছে বাংলাদেশে। বিসর্গ বলল, “রাজামশাই আমরা চাচির বাড়ি এসে গেছি।”
এটাই চাচির বাড়ি বুঝি। সাদা রঙের ইটের পাকা বাড়ি। মাথায় চকচকে টিন। একটা কাঁঠালগাছ টিনের চালে ঝুঁকে এসেছে। ডান দিকে গোয়াল, সামনে রান্নাঘর। ইট বাঁধানো বড়ো একটা উঠোন। ঘরে টিভি চলছে।
“চাচি, চাচি” বলতে বলতে টিনের দরজাটা শব্দ করে খুলে ফেলল বিসর্গ। চাঁদের আলোয় রাজামশাই দেখলেন টিনের গায়ে সবুজ রঙের লেখাটা। বিসর্গ সেই লেখাটার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “এই দেখেন স্যার, বিশ্বাস না হইলে দেখেন রাজামশাই, আমার চাচার হাতের লেখা। চাচার নাম জলিল শেখ, গ্রামের নাম চৈতন্যপুর। মেহেরপুর হইল থানা, জিলা কুষ্টিয়া, আর এই দেশটা হল বাংলাদেশ। এইবার বিশ্বাস হইল তো স্যার।”
কথার জবাব না দিয়ে অবাক তাকিয়ে আছেন রাজামশাই। কাঁঠালগাছ ডাকছে, আসুন স্যার। রাতচরা পাখি ডাকছে। সোনাঝুরির পাতা কাঁপিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছে ঝিরঝির করে। রাজামশাই স্পষ্ট শুনলেন। তারাও ডাকছে।
সবই গোকুলপুরের মতো, এমনকি সামনে দাঁড়ানো বিসর্গর চাচিকেও চিনতে পারলেন। গায়ে আটপৌরে শাড়ি, মাথায় আঁচল। হাতে সরু সরু দুগাছি কাচের চুড়ি। খুব চেনা, খুব চেনা। চাচি হাসলেন। হাসিটাও খুব চেনা, খুব চেনা। কোথায় দেখেছি, কোথায় দেখেছি। মনে পড়ল চার বছর আগে গোকুলপুরে হাসিটা শেষ দেখেছেন তিনি।
সেই হাসিটা বলল, “আইসো বাবা।”
পাশ থেকে বিসর্গ বলল, “এই আমার চাচি, রাজামশাই।”
রাজামশাই ডাকলেন, “মা!”
চমকে উঠলেন চাচি, “তুমি কী কইলা বাবা!” বলতে বলতে রাজামশায়ের হাতটা ধরে ফেললেন। তারপর বললেন, “এ তুমি কী কইলা বাবু?”
রাজামশাই কথা বলছেন না। চার বছর আগে গোকুলপুরে দেখা শেষ হাসিটা এই মেহেরপুরে অবিকল ফিরে এল।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি