"১৯৪৬ কোজাগরী পূর্ণিমা" নোয়াখালীর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিধনের জ্বলন্ত দলিল।
১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কলকাতায় মুসলিম লীগ দ্বারা পরিচালিত প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের পর থেকে নোয়াখালীর রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক জীবনে অদ্ভুত এক পরিবর্তন আসতে শুরু করে, যা ধীরে ধীরে এক ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী নরনিধনের
ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকে। এই আক্রমণ সমাজের শোষক শ্রেনীর বিরুদ্ধে শোষিতের আক্রমণ ছিল না। যদি তাই হতো, তাহলে গরীব হিন্দু চাষি, মাঝি, মল্লার এবং জেলে শ্রেণির ওপর এই আক্রমণ আসতো না। প্রায় দু'মাস ধরে বাইরে থেকে পেট্রল এনে আক্রমণের কেন্দ্রস্থলগুলোতে তা সঞ্চয় করা হতে থাকে। এত বিপুল পরিমানে পেট্রল কোথা থেকে আনা হয়েছিল এবং কারা তা সরবরাহ করেছিল তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকে বলেন বিদেশী রাজনৈতিক দল, আবার অনেকে বলেন সরকারের প্ররোচনায় এই আক্রমণ সংগঠিত
হয়েছিল। ঘটনা যা-ই হোক, ১০ই অক্টোবরের আগে সমস্ত সরকারী আধিকারিকদের বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ এবং প্রশাসনের চোখের সামনে সমস্ত ঘটনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হলেও সকলে নির্বাক দর্শকের
ভূমিকা নিয়েছিল। অবশেষ আক্রমণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার পর আসে সেই রক্তক্ষয়ী দিন, ১৯৪৬ কোজাগরী পূর্ণিমা। এই উপন্যাসের মাধ্যমে ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত কলঙ্কিত অধ্যায়কে তুলে ধরা হয়েছে। কোনো একটি সম্প্রদায়কে যদি শেষ করে দিতে হয়, তাহলে সেই সম্প্রদায়ের গর্ভ দখল করে নিতে হবে। যুগ যুগান্ত ধরে এই জন্য
এই ধরনের হিংসাত্মক ঘটনায় সব থেকে বেশী আক্রান্ত হয়েছে নারী। নোয়াখালীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে তিনটে রাস্তা খোলা ছিল, ধর্ম পরিবর্তন করো, মরো না হয় পালাও। এছাড়া ব্যাপকভাবে গৃহে অগ্নি সংযোগ, বাড়ির পুরুষ সদস্যদের হত্যা, শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ এবং নারীদের ধর্ষণের মতো ঘটনা মাসের পর মাস চলতে থাকে।
নোয়াখালীতে গান্ধীজির সফরসঙ্গী সুচেতা কৃপালনী এবং অশোকা গুপ্তা এমন এক পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যে পরিবারের স্ত্রীকে রোজ তিন থেকে চারজন এসে রাতের অন্ধকারে নিয়ে যেতো, তারপর আবার ভোরবেলায় ফিরিয়ে দিয়ে যেতো। পরে এই পরিবারটি দেশত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরকম বহু ভয়ঙ্কর ঘটনা এই উপন্যাসের
মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তবে আমার মনে হয় নোয়াখালী আমাদের কাছে একটা শিক্ষা। শ্রদ্ধেয় চপলকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর গ্রন্থের ৬৪ নম্বর পাতায় লিখেছেন যে নোয়াখালীর ধ্বংসের চিত্র দেখে তাঁর মনে হয়েছে আনন্দমঠের লেখকের পুনরাবির্ভাবের প্রয়োজন। যে জাতির মধ্যে একতা নেই,
নিজেরা নিজেদের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ খেউখেই করে মরছে,এদের জন্য যতই লেখা হোক, এদের চৈতন্য হবে না। ১৯৪৬ সালে ১৮ই অক্টোবর গান্ধীজি তাঁর প্রার্থনা সভায় বলেছিলেন, আক্রান্ত হওয়ার আগেই যেন মেয়েরা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে নেয়। কারণ, আক্রমণকারীদের কাছে অস্ত্র আছে আর আমরা নিরস্ত্র। এই শিক্ষাই তো আমাদের দেওয়া হয়েছে।
হাজার বছর আগেও আমাদের মধ্যে একতা ছিল না, আজও নেই। কোনো লেখা কিংবা ঘটনা আমাদের একত্রিত করতে পারবে না। তবে নোয়াখালী একটি শিক্ষা, দুর্গাপুজোর সময় কলকাতা এবং ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিবারের সদস্যরা এই সময় দেশের বাড়িতে ছুটি কাটাতে ফেরেন। তাই এই সময়টিকে নির্বাচন করা হয়েছিল। নোয়াখালির
চারিদিকে নদী, তাই পালানোর সমস্ত পথ থেকে তারা নোয়াখালীর প্রতিটি দ্বীপকে বিচ্ছিন্ন করে আক্রমণ চালাতে শুরু করেন। স্থলপথ এবং জলপথ দুই দিক দিয়ে এই ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালানো হয়েছিল। আক্রমণের আগে প্রত্যেকে গ্রাম ধরে ধরে সংখ্যালঘু পরিবারগুলির নামের তালিকা এবং আর্থিক অবস্থা লিপিবদ্ধ করা হয়। এক কথায় ১৯৪৬ নোয়াখালী এক দীর্ঘ
পরিকল্পনার ফসল। গান্ধীজির উপস্থিতিতেও এই হিংসাত্মক ঘটনা বন্ধ হয়নি।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.