বই : আমি নারী আমি মহীয়সী
লেখক : ড. মহুয়া দাশগুপ্ত
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী — বাঙালি মেয়েদের দক্ষিণের বারান্দা
উনিশ শতকে বাঙালি মেয়েদের জীবন ছিল খাঁচায় বন্দী পাখিদের মতো। বাইরের পৃথিবীতে রেনেসাঁর আলো, অথচ বাঙালির অন্দরমহল তখনও আঁধারে । উনিশ শতকের মেয়েদের লেখা চিঠিপত্রেও রয়ে যায় মনকেমনের সুর — ‘ধন্য পুরুষজাতিকে। স্ত্রীলোকের ন্যায় যদ্যপি পুরুষের এককণা যন্ত্রণা হইত তাহা হইলে প্রণয়ে কি সুখ হইত!’ আসলে পিঞ্জরমুক্ত হওয়ার ইচ্ছেটা তৈরি হচ্ছিল বাঙালি অন্দরমহলের আনাচকানাচে। বাঙালির সামাজিক জাগরণ পর্বে দুটি পরিবারের উল্লেখ করতেই হয়। একটি কাঁটালপাড়ার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার আর অন্যটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। অথচ বঙ্কিমের ছোটমেয়ে উৎপলকুমারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছিলেন। বঙ্কিমের বড় মেয়ে শরৎকুমারীর বিধবা পুত্রবধূ কমলার দ্বিতীয় বিবাহ নিয়ে মামলা হয়েছিল। এর পাশাপাশি ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও গঙ্গাস্নান করতে যেতেন যখন, তাঁদের পালকিশুদ্ধ জলে ডুবিয়ে আনা হত। রবীন্দ্রনাথের মা সারদাদেবীকে দেবেন্দ্রনাথের পাত্রী হিসেবে নির্বাচন করে নিয়ে আসা হয়, তাঁর মায়ের অমতে। সেই খবর পেয়ে সারদাদেবীর মা মেয়ের বিচ্ছেদে কেঁদে কেঁদে মারা গিয়েছিলেন। এইসব ঘটনাকে উনিশশতক তুচ্ছই মনে করত বোধহয়! সেইসময় মেয়েরা প্রতিবাদ করতে বা সাহসী পদক্ষেপ নিতে জানত না। সেইসময়কার এক অন্যরকম মেয়ের গল্প বলি আজ। বাঙালি মেয়েদের ‘আধুনিক’ করে তোলার অন্তরালে তাঁর ভূমিকা অসীম। আজকের কথকতা আবর্তিত হোক সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে ঘিরে।
মোহিতকুমারী — ঠাকুরবাড়ির এক মহিলা আত্মজীবনীকার
মোহিতকুমারী ছিলেন ঠাকুরবাড়ির মেয়ে এবং ঠাকুরবাড়িরই বৌ। বাবার ঘরে তাও পর্দাঘেরা পালকি চড়ে গঙ্গাস্নানে যেতে পারতেন। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি এসে গঙ্গাস্নানও নিষিদ্ধ হয়ে গেল। মেয়েদের রেলগাড়ি চড়া, ঘোড়ার গাড়ি চড়ার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারতেন না। মোহিতকুমারী ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে সুনন্দিনীর শাশুড়ি । মোহিতকুমারীর বাবা ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার অতীন্দ্রনাথ ঠাকুর। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত,টানাপোড়েন পেরিয়ে শেষ বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন মোহিতকুমারী, সকলের কাছে পরিচিত হয়েছিলেন ‘সাধুমা’ নামে। ঐশ্বর্যশালী পরিবারের মেয়ে এবং বৌ হওয়ার পরেও ঠিক কোন বোধ বা কোন চেতনা থেকে তিনি সংসার ছেড়েছিলেন সেকথা জানা যায় না। কারণ তাঁর আত্মজীবনীটির সম্পূর্ণ অংশ মুদ্রিত হয় নি এবং পাওয়া যায় না। তবে যেটুকু পাওয়া যায়, তাইই সেই আমলের ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের জীবনের প্রামাণ্য দলিল। মোহিতকুমারীর ঠাকুরবাড়ির সম্পর্কে ধারাবাহিক লেখাটি ইন্দিরাদেবী তুলে দিয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্রবধূ হেমলতার কাছে। তবে সম্পূর্ণ রচনাটি প্রকাশিত না হওয়ায় মোহিতকুমারীর প্রবজ্যা নেওয়ার পরের জীবন সম্পর্কে জানা যায় না।
*** ঠাকুরবাড়ির লক্ষ্মী মেয়ে ***
কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে বাঙালির ঘরে ঘরে যে লক্ষ্মীর আরাধনা হয়, সেইসব লক্ষ্মী মেয়ে তো পরিবারের মধ্যেই থাকে। ঠাকুর পরিবারেও ছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে সৌদামিনী দেবী। সারদা দেবীর মৃত্যুর পর বড় মেয়ে সৌদামিনীর হাতেই সংসারের সব ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। সৌদামিনীও জড়িয়ে পড়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে। ছোট থেকে জোড়াসাঁকোর বিবিধ ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা ‘পিতৃস্মৃতি’ থেকে সেই আমলের অনেক ঘটনার কথা জানাও যায়। দেবেন্দ্রনাথ যখন কঠোরভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করছেন এবং অন্দরমহলেও উপাসনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন,তখনকার কথা জানা যায় সৌদামিনীর লেখা ‘পিতৃস্মৃতি’ থেকে। সহজাত দেবসংস্কার ভুলে যাওয়া কঠিন। কাজেই দেবেন্দ্রনাথের সামনে ব্রহ্ম উপাসনা অব্যাহত ছিল। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে গোপনে পুতুল পুজো করা হত। একসময় সৌদামিনী শিবপুজো, ইতুপুজো সব করেছেন । দুর্গাপুজোর সময় প্রতিমার সামনে অঞ্জলি না দিয়ে জলগ্রহণ করতেন না। পরে গোপনে নিজের ঘরের কৃষ্ণের ছবিতে ফুল দিয়ে পুজো করতেন। বড় মেয়ে , তাই বাবা মা অনেক কথা ভাগ করে নিতেন তাঁর সঙ্গে। একবার সিপাহী বিদ্রোহের সময় গুজব উঠেছিল দেবেন্দ্রনাথকে হত্যা করা হয়েছে। সারদাদেবী সেইসময় আহার নিদ্রা ত্যাগ করেন। তারপর দেবেন্দ্রনাথের সুস্থতার খবর পেয়ে স্বস্তি। দেবেন্দ্রনাথ সৌদামিনীকে বলেছিলেন এক আশ্চর্য ঘটনা। দেবেন্দ্রনাথ তখন সিমলাতে। এইহময় তাঁর পুত্র পুণ্যেন্দ্রের অকাল মৃত্যু হয়। দেবেন্দ্রনাথ সেই মৃত্যুর সংবাদ পান নি। কিন্তু দিনের বেলা জাগ্রত অবস্থায় দেখেছিলেন পুণ্যেন্দ্র কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে আছে। এমন অনুভূতি দেবেন্দ্রনাথের আগেও হয়েছিল।
*** এক শিল্পীর গল্প **
ঠাকুরবাড়ির মেয়ে সুনয়নীকে আমরা চিনি। অবনীন্দ্রনাথের এই গুণবতী বোন নিজেও ছিলেন চিত্রশিল্পী । ছেলে মেয়ে ছিল তাঁর।বেনেপুকুরে তাঁর বাড়িতে সব মিলিয়ে প্রায় একশো জন সদস্য ছিল। সুনয়নীর বড় ছেলে রতনমোহনের সঙ্গে বিয়ে হয় কল্যাণীর। তাঁর বাবা ছিলেন জগদীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একমাত্র মেয়ে ছিল তাঁর বড় আদরের । নিজে চিত্রশিল্পী ছিলেন, মেয়েকেও উৎসাহ দিয়েছিলেন ছবি আঁকায়। কিন্তু মাত্র দশ বছর বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন এবং কল্যাণী হলেন সুনয়নীর পরিবারের অংশ। তবে শিল্পী মেয়েটি ঠিক জায়গাতেই এসেছিলেন। শ্বশুরবাড়িতে এসে কল্যাণী পেলেন আরো অনুকূল পরিবেশ। কল্যাণী এই পরিবারের অন্য বধূদের মতো ছবি আঁকা শিখতে শুরু করেন। এমন একটি দিন এল যখন কল্যাণীর আঁকা ছবি জায়গা পেল কলকাতা চিত্র প্রদর্শনীতে । শুধু তাই নয় পুরস্কৃতও হল। তবে কল্যাণী শুধুমাত্র পারিবারিক ধারায় চিত্রশিল্পী হয়ে রইলেন না। তিনি নিজের অন্য এক পরিচিতি তৈরি করলেন। তিনি লেখিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। বার বার ডাক পেতে লাগলেন আকাশবাণীতে। সেখানে স্বরচিত গল্প ও কবিতা পাঠ করে পাঠকের মনোরঞ্জন করতেন নিয়মিত। অন্দরমহলে মুক্তির অবকাশ কম ছিল। এই সাহিত্য সাধনাই কল্যাণীকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দিয়েছিল। তাঁর গল্পের চরিত্ররা মনের গহন থেকে উঠে এসেছে। ‘গৌরী দান’ গল্পে রাণুর বাল্যবিবাহ কল্যাণীর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথাই বলে। বড় ঘর থেকে আসা সম্বন্ধ উপেক্ষা করতে না পেরে গল্পের চরিত্র রাণুর বাবা মেয়ের বাল্যবিবাহ দিয়ে দেন। মনে হয় কল্যাণীর বাবাও একই যুক্তিতে কল্যাণীর বিয়ে দিয়েছিলেন অল্পবয়সে। অথচ বড় ঘর পেলেও যে একটি মেয়ের মন যে নিজের ছেলেবেলার ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে,অবকাশ পেলে ফাঁকা মনটা গুমরে ওঠে নিজের প্রিয় গৃহটির জন্য—একথা গল্পকথনের আড়ালে বলেই দিয়েছিলেন কল্যাণী। শ্বশুরবাড়িতে ছোট্ট মেয়ের মনকেমন করেছে ঘাগড়া পরা পুতুলের জন্য। কল্যাণী সেইসব মনখারাপের হিসেব নিকেশ শব্দ বন্দী করে রেখে দিতেন নিজের লেখায়।
*** ছোটমেয়ের চোখে রবিঠাকুর ***
মীরা দেবী রবীন্দ্রনাথের ছোটমেয়ে। জীবনের ঘাতপ্রতিঘাতে মীরা দেবী একটা সময়ের পর শান্তিনিকেতনেই থাকতেন। নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে মানসিক দূরত্বের কারণে তাঁরা একসঙ্গে থাকতে পারেন নি। মনের কষ্টের কথা সেভাবে কাউকে বলতেন না মীরা দেবী। রবীন্দ্রনাথ আগলে রেখেছিলেন ছোট মেয়েকে। মীরা দেবীর লেখা লেখা ‘স্মৃতিকথা’ থেকে রবীন্দ্রনাথের স্নেহপ্রবণ পিতৃহৃদয়ের কথা জানা যায়। মেয়ের কলমে বাবার অবয়ব স্পষ্ট হয়। মীরা দেবী প্রথমবার শান্তিনিকেতন যাওয়ার গল্প বলেছিলেন। ট্রেনে চড়ে অবধি এক আশ্চর্য উদ্দীপনা অনুভব করছিলেন ছোট্ট মীরা। স্টেশনের বাইরে তাঁদের জন্য একটি বড় আয়তনের বাসের মতো দেখতে গোযান দাঁড়িয়েছিল। ভিতরে অনেকটা বসার জায়গা। গাড়িটা টেনে নিয়ে গিয়েছিল চারটে হৃষ্টপুষ্ট বলদ। শান্তিনিকেতনে দোতলার একটি ঘর, বাবা,মা, ভাই, বকুলগাছতলায় খেলার জায়গা, শিশিরভেজা শিউলিফুলের গন্ধ—এইসব নস্টালজিয়া মীরা দেবীর লেখা স্মৃতিকথায় রয়েছে। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের অনেক কথা জানা যায় মীরা দেবীর কথন থেকে। রবীন্দ্রনাথের ছিল সিঁড়ির শখ। তাঁর যেকোনো বাড়িতেই অন্তত দুটো করে সিঁড়ি থাকতই। লেখক রবীন্দ্রনাথকেও কাছ থেকে দেখেছেন মীরা দেবী। সেই যে সকালবেলায় লিখতে বসতেন রবীন্দ্রনাথ, একমাত্র স্নানাহারের সময় ছাড়া উঠতেন না। লেখা তাঁর কাছে তপস্যা ছিল। তখন শান্তিনিকেতনে গ্রীষ্মকালে গরম লু বইত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রবল গরমেও জানালা বন্ধ করতে দিতেন না। এই সূত্রে মীরা দেবী মজা করে লিখছেন, ‘বাবা জন্মেছেন বৈশাখের খররৌদ্রে। তাই বোধহয় রোদকে ভয় কয়তেন না। সূর্যের সঙ্গে তাঁর মিতালি ছিল।’ মীরা দেবী মাতৃহীন সেই ছেলেবেলাতেই। ব্যস্ত বাবা রবীন্দ্রনাথ কিন্তু মেয়ের মুখ দেখেই বুঝে যেতেন মেয়ে মনে ব্যথা পেয়েছে। মীরা দেবী লিখছেন, ‘বাবার কাছে এত স্নেহ পেয়েছি যে মা’র অভাব কোনোদিন বোধ করিনি। ’
*** ইতি বেলা ***
সে এক সময় ছিল, যখন কাগজ কলমে ফুটে উঠতো মনের আবেগ। চিঠির পাতায় পাতায় শব্দ হয়ে ফুটে থাকতো কষ্টকুসুম। আদর , সোহাগ , স্নেহে ভরাট সে শব্দের ফুল সুগন্ধী স্মৃতির মতো ধরা থাকতো । সে চিঠি যদি হয় কবি পিতাকে লেখা তাঁর আদরের মেয়ের চিঠি , তাহলে তো কথাই নেই। মাধুরীলতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়ো মেয়ে, আদরের বেলি। তাঁর জীবনকথা তো অনেকটাই জানা। মাধুরীলতার সংক্ষিপ্ত জীবন, বিক্ষিপ্ত দাম্পত্য,অপূর্ণ ইচ্ছেরা আজ আমাদের কথকতার বিষয় নয়। আজ শব্দের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করবে এক অকপট বালিকা। বাবার উপর যার মস্ত অধিকার ।
মাধুরীলতা সাহিত্যরচনাও করেছিলেন। বাংলা ভাষার উপর আশ্চর্য দখল ছিল তাঁর। চিঠি লেখার সময় মাধুরীলতার সাহিত্যিক প্রতিভা আর রসবোধ একসঙ্গে লক্ষ করা যায়। মাধুরীলতার চিঠি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের এক বিশেষ সত্তা, একটি বিশেষ সময়ের দিকে ইঙ্গিত করে। সেই দিক থেকে চিঠিগুলি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৮৯৫ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত কিছু চিঠির সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়। আমাদের আলোচনার কেনদ্রে থাক ওই চিঠিগুলিই। জোড়াসাঁকো, ভবানীপুর,শিলাইদহ, মজঃফরপুর ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় বসে এক সরল বালিকা তার বাবাকে চিঠি লিখছে,তার দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে চিঠির পাতায়। বিখ্যাত বাবার কাছে এ প্রাপ্তি কিছু কম নয়।
চিঠির বয়ান জীবনের গল্প তৈরি করেছে আনমনে। মনের ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে ওঠে জীবনের জলছবি। ছোট্ট বেলা চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে, মা সমস্তদিন বই পড়েছেন বলে চিঠি লিখতে পারেন নি। তাই ছোট্ট বেলা এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। চিন্তামগ্ন বাবার জন্য ‘হামি’ পাঠিয়েছে অগুনতি। অঙ্কের আতঙ্ক, মাঝির গান, বাদলা দিন—এইসব সহজিয়া প্রসঙ্গ যেমন চিঠির বয়ান হয়েছে, তেমনি চুপি চুপি পত্রলেখক মেয়েটি জানিয়েছে তার ইচ্ছের কথা —‘আমি মনে মনে এই বিবেচনা করিয়াছি যে সিলাইদায় গিয়া তোমার মতো রোগা হইব। ’মাঝে মাঝে চিঠিতে উঁকি দিয়েছে অভিমান —‘বলুদাদাকে বল আমাকে আগে চিঠি লিখতে নাহলে আমিও তাঁকে লিখিব না।’ রবিঠাকুরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাবার চিঠি নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যেতো। ছোটো ভাই রথীর অভিমানের খবরও দিদি মাধুরীলতা পৌঁছে দিতো পত্রের হরফে হরফে। কখনো আবার মেয়ের চিঠির সঙ্গে দুইকলম চিঠি লিখে দিতেন মৃণালিনীও। সে চিঠির মাত্রা ও গুরুত্ব হতো অন্যরকম। বেশ কয়েকটি চিঠিতে এসেছে মিস্টার লরেন্সের প্রসঙ্গ। এই প্রবল আবেগপ্রবণ সাহেব রবীন্দ্রনাথের সন্তানদের গৃহশিক্ষক ছিলেন একসময়। সাহেবের দরিদ্র মানুষদের কথায় কথায় অশিক্ষিত, অসভ্য বলার প্রবণতা মেনে নিতে পারে নি কিশোরী বেলা। উল্টে বাবাকে চিঠিতে জানিয়েছে, তার মনে হয়, শিক্ষিত সভ্য মানুষদের থেকে এরা অনেক বিশ্বাসী ও সরল।
*** আঁধার ঘরের বন্ধু ***
১৯২১ সালের ৪ জানুয়ারি! বিশ্ববিখ্যাত কবির সঙ্গে দেখা হবে বলে একটি মেয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মেয়েটি কি মনে মনে অস্ফুটে উচ্চারণ করছেন কোনো গান? নীরব উচ্চারণে বলছেন কি—
‘Yes Master, I forget,
I ever forget, that the
Gates are shut every
Where in the house
Where I dwell alone!
মেয়েটির তিনটি ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ। তবু কোন এক আলোর পথে যেন তাঁর বুকের ভিতর জেগে ওঠে শব্দ ভ্রমর—‘ কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার সেকথা যে যাই পাশরি’! দিনটা ছিল সেই আলোর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন। মেয়েটি হেলেন কেলার আর সেই আলোর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!আজকের কথকতায় রইল একটি মেয়ের অন্ধকারের উৎস থেকে আলোর পথে যাত্রার কাহিনি এবং তাঁর পথপ্রদর্শক এক ভারতীয় কবির গল্প।
হেলেন কেলার জন্মেছিলেন আর পাঁচটি স্বাভাবিক শিশুর মতোই। উনিশ মাস বয়সে এক অসুখে হারিয়ে গেল তাঁর দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি। কিছুদিন পর বন্ধ হল কথা বলাও। এক মৌন , নিঃশব্দ, অন্ধকার পৃথিবীতে কেউ যেন তাঁকে জোর করে আটক করল। অথচ এমনটা হওয়ার কথাই ছিল না। সেই আঁধারে পথ হারিয়ে ফেলাটাই মনে হয় ভবিতব্য ছিল হেলেনের। কিন্তু আসল রূপকথা শুরু হল ঠিক তখনই। মায়ের সাহায্য আর নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে হেলেন বিশ্ববিখ্যাত হলেন। চব্বিশ বছর বয়সে তিনি আমেরিকার রাডক্লিফ কলেজ থেকে কোনো সংরক্ষণ ছাড়াই পরীক্ষা দিলেন এবং ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক হলেন। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও তাঁর টাইপ করা উত্তরপত্রগুলি রয়েছে। মার্ক টোয়েন হেলেন কেলারকে উনিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ বলেছিলেন। তাঁর অষ্টআশি বছরের দীর্ঘ জীবন কত মানুষকে আলোর নিশানা দিয়েছে। অথবা তিনি নিজেই ছিলেন একটি দীপশিখা!
******
রবিঠাকুর বা ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মহীয়সী নারীদের জীবনের কিছু কথা বলে এই বই।
গল্পকথা নয়, এ বই সত্যি ঘটনা বলে।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.