বই : ভিত
লেখক : পল্লবী সেনগুপ্ত
শ্রেয়ান নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালো নিজের পুরোনো শোবার ঘরের বাইরে l এক সময় যে ঘরটা ওর একেবারে নিজের ছিল তার সাথে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে আজ তা একেবারেই পর হয়ে গেছে যেনl আসলে জীবনই এমন !কে যে কখন আপন থেকে পর হয়ে যায় একেবারে টেরই পাওয়া যায় না l
নিজের প্রিয় শোবার ঘরটা একটু একটু করে অচেনা হতে শুরু করেছিল শ্রেয়ান স্যানালের কাছে সেইদিন থেকেই যেদিন জয়িতাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বৌ করে নিয়ে আসতে হয়েছিল আর তার জায়গা হয়েছিল ওই ঘরে l বিগত কয়েকমাসে জয়িতার সাথে যত অশান্তি , যত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি তার সব টুকুই তো এই ঘরেই l তাই এ ঘর আর প্রিয়র তালিকায় থাকবেই বা কি করে ! অবশ্য যত যাই হোক তবু শোবার সময়টুকু এই ঘরে আসা বন্ধ করেনি কখনো শ্রেয়ান , সে মনে যতই ক্লেদ থাকুক না কেন l জয়িতা কাঠ হয়ে পড়ে থাকতো ডিভানে আর শ্রেয়ান নিজের বিছানাতেই ঘুমাতl কিন্তু জয়িতার সাথে ওই নারকীয় কান্ডটা ঘটিয়ে ফেলার পর আর এই ঘরে পাও রাখতে পারেনি শ্রেয়ান l ভয় হচ্ছে জয়িতার মুখোমুখি হতে l যে মানুষটি নিজের চোখেই চোখ রাখতে পারছে না সে কি করে তাকাবে জয়িতার দিকে ?
কিন্তু আজ যাই হয়ে যাক শ্রেয়ান একটিবার জয়িতার মুখোমুখি হবেই l এই পাপবোধের নরক যন্ত্রনা আর যে বয়ে বেড়াতে পারছে না শ্রেয়ান স্যানাল l আজ ক্ষমা হোক বা শাস্তি , কিছু একটা ও জয়িতার থেকে নিয়ে তবেই যাবে ও l
শোবার ঘরের দরজা বন্ধ l ভিতর থেকে ঘুঙরের ছমছম শব্দ ভেসে আসছে l জয়িতা কি তবে নাচ করছে ? ও হ্যাঁ ও তো খুব ভালো ডান্সার l বিয়ের আগে তেমনটাই তো বলেছিলি বোধহয় জয়িতার বাপের বাড়ি থেকে l কিন্তু সে নাচ এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে ও ?
থাক এখন এসব ভেবে লাভ নেই l বুকের মধ্যে অস্বস্তির একটা নদী যেন বয়ে চলেছে শ্রেয়ানের l তবু মন শক্ত করার চেষ্টা করলো ও l কোনক্রমে সাহস সঞ্চয় করে ও হালকা ধাক্কা দিলো দরজায় l
নাচের ছমছম থেমে গেলো প্রায় সাথে সাথেই l কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালো জয়িতা l শ্রেয়ানকে দেখেই তার কপাল জুড়ে জেগে উঠল ভ্রূকুটি l অসম্ভব গম্ভীর গলায় সে জিজ্ঞাসা করলো
' আপনি ? এখন এখানে ?'
জয়িতার মুখোমুখি হতেই বুকের মধ্যে অস্বস্তিটা যেন লক্ষ গুন্ বেড়ে গেলো শ্রেয়ানের l আমতা আমতা গলায় কোনোমতে বললো
' জয়িতা আমি মানে ' ۔۔۔
' ভীতরে আসুন ' l আবার গম্ভীর গলায় বললো জয়ি l
ধীর পায়ে ভিতরে ঢুকলো শ্রেয়ান l খাটের উপর ছড়িয়ে রয়েছে এক জোড়া ঘুঙরু l জয়িতার পোশাক দেখেও বোঝা যাচ্ছে সে নাচ করছিলোl
শ্রেয়ান ঠিক বুঝতে পারল না কিভাবে কথা শুরু করা উচিত l তাই কিছুটা বোকার মতোই বলে ফেললো
' তুমি নাচ করছিলে জয়িতা ' ?
' হ্যাঁ করছিলাম l আর ভবিষ্যতেও করবো l কারণ আমি মনে প্রাণে একজন নৃত্যশিল্পী l নাচকে রীতিমতো পুজো করি আমি l কিন্তু আমার পরিবার , আমার বাবা কোনোদিন চান নি আমি নাচ করি l তাই ইচ্ছাকৃতভাবেই তিনি বিয়ে দিয়ে আমায় পাঠিয়ে দিলেন এই স্যানাল বাড়ির মতো এমন এক বাড়িতে যেখানে মেয়েদের ইচ্ছে আর স্বপ্নকে খুব সুচারু ভাবে খুন করতে জানে সবাই l কিন্তু হিসাবটা বোধহয় এতটাও সহজ না l মেয়েদের ইচ্ছা , মেয়েদের স্বপ্ন চাইলেও দলে পিষে শেষ করে দেওয়া যায় না l মেয়েরাও পারে ঘুরে দাঁড়াতে l মেয়েরাও পারে প্রতিবাদ করতে l আমার মতো মফস্বল এর সাধারণ মেয়েরাও পারে ' l একটানা এতটা বলে থামলো জয়িতা l শ্রেয়ান চুপ l কয়েক মুহূর্তের নীরবতা ছড়িয়ে গেলো সর্বত্র l
' জয়িতা , জয়িতা আমি জানি আমি ক্ষমার তো যোগ্য নই , কিন্তু তবুও যদি ۔۔۔ আমি যে আর পারছি না এই অপরাধের গ্লানি বয়ে বেড়াতে ' !জয়িকে চরম চমকে দিয়ে সব নীরবতা ভেঙে বলে উঠলো আচমকা শ্রেয়ান l
' কি ! ক্ষমা ' ? জয়িতার গলায় এক রাশ বিস্ময়l
' হ্যাঁ ক্ষমা l জানি আমি যোগ্য নই l কিন্তু ۔۔۔ '
' কতজনের কাছে ক্ষমা চাইবেন আপনি শ্রেয়ানবাবু ? কিভাবেই বা কমাবেন আপনার অপরাধবোধ ? আপনার অপরাধ যে অসংখ্যl সব অপরাধের কি ক্ষমা আদৌ পাওয়া যায়? কি মনে হয় আপনার ' ?
' মানে ? এসব কি বলছো তুমি ' ? চমকে গেছে শ্রেয়ান l
' আমি ঠিকই বলছি শ্রেয়ান বাবু l আমার তো না হয় আপনি শুধু শরীরটা কে ধর্ষণ করেছেন কিন্তু রাত্রিদি ? দিনের পর দিন তার আত্মাকে ধর্ষণ করেছেন আপনি l তাকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন ছেঁড়া চটির মতো l তারই চোখের সামনে দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন শুধু নিজের এই বিলাসবহুল জীবনটা স্যানাল বাড়িতে টিকিয়ে রাখার জন্যl আপনার মেরুদন্ডহীনতা , আপনার কাপুরুষতার জন্য প্রতিদিন খুন হতে থেকেছে রাত্রিদির আত্মা l তার আত্মসম্মান l রক্তাক্ত হয়েছে তার হৃদয় l অথচ আপনি ? আপনি জানার চেষ্টাটুকুও করেননি কখনো l পৌরুষের দম্ভে মগ্ন ছিলেন আপনি ' l
' জয়িতা , তুমি ۔۔۔ তুমি ' ۔۔۔
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.