বিভূতিভূষণের দিনলিপিসমূহকে দু’টি পর্বে ভাগ করে দেখা যেতে পারে। তাঁর জার্নাল এবং ডায়েরি। চরিত্রগত ভাবে এই দুইয়ের মধ্য্যে ফারাক বিস্তর। জার্নালের বিভূতিভূষণ গভীর চিন্তায় মগ্ন এক সাধক। আর ডায়েরিতে স্বামী, প্রেমিক, পিতা, জেষ্ঠভ্র্রাতা, বন্ধু, আড্ডাবাজ এক মানুষ। মনে হতেই পারে, কী করে সেতুবন্ধন সম্ভব হয় এই দুই সত্তার। বহুবিধ চর্চার অধিকারী বিভূতিভূষণকে জানতে বা বুঝতে হলে প্রয়োোজন তাঁর যাবতীয় জার্নাল ও ডায়েরির নিবিড় পাঠ। ‘দিনলিপির বিভূতিভূষণ’-এর দুই খণ্ড ব্যেপেে তারই আয়োজন।
দিনলিপির বিভূতিভূষণ: জার্নাল ও ডায়েরি সংগ্রহ ১,২ খণ্ড
সম্পাদনা ও টীকা: চণ্ডিকাপ্রসাদ ঘােষাল
যে লেখার মূল উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়ে পাঠকের হাতে পৌঁছে যাওয়া, সেখানে লেখক যে ভাবে প্রকাশ করেন নিজেকে, নিভৃত পরিসরের প্রকাশভঙ্গি তার চেয়ে কতখানি আলাদা? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরি ও জার্নালের ক্ষেত্রে প্রশ্নটিতে আরও একটি স্তর যােগ হয়— জার্নাল লেখার ক্ষেত্রে লেখক সম্ভবত জানতেন যে, এখনই না হলেও কোনও এক সময় তা প্রকাশিত হয়ে পাঠকের হাতে পৌঁছবে। ফলে, উপন্যাস-জার্নাল-ডায়েরি, এই তিন স্তরে আত্মপ্রকাশের স্বর কি পৃথক ছিল? সেই পার্থক্য কি সচেতন? বর্তমান সঙ্কলনে সম্পাদক লিখেছেন, “ডায়েরির বিভূতিভূষণ ও জার্নালের বিভূতিভূষণ সর্বত্র এক নন। হওয়ার কথাও নয়। ডায়েরিতে তিনি মূলত দর্শক, অংশগ্রহণকারী ও বহমান সময়ের ধারা থেকে আহৃত মুহুর্তের লিপিকার। জার্নালে তিনি বস্তুত একজন পরিব্রাজক।”
দুই পরিসরে কী ভাবে দেখতেন বিভূতিভূষণ? জার্নালে (তৃণাঙ্কুর, ১৯২৯-১৯৩৫) তিনি লিখছেন, “বাস্তবিকই গ্রামের লােকের সংকীর্ণতা এত বেশি— মনকে বড় পীড়া দেয়। এদের মন চারিধার থেকে শৃঙ্খলিত—খুলবার অবকাশ নেই।” সেই একই সময়কালে, ১৯৩৩ সালের জুলাইয়ে, গ্রামাঞ্চলের এক বিয়েবাড়িতে খানিক তিক্ত অভিজ্ঞতা হল তাঁর। বরপণ নিয়ে পাত্রপক্ষের তুমুল অশান্তির সাক্ষী থাকলেন তিনি। সঙ্কীর্ণতাই তাে। ডায়েরিতে কিন্তু ভিন্ন সুরে লিখলেন বিভূতিভূষণ— “সামান্য ৬/৮ টাকার জন্যে বৃদ্ধ বরকর্তা কী পীড়াপীড়িই না করলে। কিন্তু সে অত্যন্ত গরীব বলে। আমার বড় কষ্ট হলাে—এই সামান্য টাকা এর কাছে কত টাকা।”
ডায়েরি কোথায় এসে উপন্যাসের সঙ্গে মেশে, তারও একটা উদাহরণ রয়েছে এই পাতাতেই। মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, 'অপরাজিত' প্রকাশিত হয়েছে এর আগের বছর। ১৯৩৩ সালের এই বিয়েবাড়ির সম্বন্ধে ডায়েরিতে লিখেছেন— "বরও পছন্দ হল না কারুর... নগেন খুড়াে বললে, ও বর ফেরৎ দিয়ে মানুর সঙ্গে তােমায় সপ্তপাক ঘুরিয়ে দি।” তার পর অবশ্য উপন্যাসের পথ ছাড়ল বাস্তব। ডায়েরিতে লেখা: “আমি অবশ্য... অস্বীকার করলুম। খুড়াে কেঁদে ফেললে; এ বরে কেন মেয়ে দেবাে বলে পিসিমাও কাঁদলেন। শেষে বিয়ে হয়ে গেল।”
[আনন্দবাজার পত্রিকা/পুস্তক পরিচয় বিভাগে প্রকাশিত প্রতিবেদন ২৬ মার্চ ২০২১]
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.