কমলকুমার মজুমদারের চিঠি
সংকলন ও সম্পাদনা : প্রশান্ত মাজী গৌতম মণ্ডল।
পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ।
প্রচ্ছদ : সুমন কবিরাজ
কমলকুমার মজুমদারের চিঠির সংকলনটি নতুন করে গ্রন্থিত করতে গিয়ে এখন মনে হচ্ছে এটি তাঁর সৃষ্টির একটি গোপন নির্মাণকোষ, যেখানে লেখকের ব্যক্তিমানস, নন্দনচেতনা, জীবনের প্রতি তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাষা-সৃষ্টির নেপথ্য-প্রক্রিয়া একত্রে উপস্থাপিত হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে লেখকের শানিত বিদ্রূপ। আয়রনি। দেশ ও বিদেশের সাহিত্য ও শিল্প সম্পর্কে অকপট মতামত। তাঁর লেখা ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাস কিংবা চিত্রকলা বহু আলোচনা এবং পুনর্ব্যাখ্যার জন্ম দিলেও, তাঁর ব্যক্তিগত এই চিঠিগুলো তাঁর সৃজন-প্রক্রিয়ার সেইসব স্তরকে আলোকিত করে, যেগুলো সরাসরি টেক্সটে রূপান্তরিত হয়েছে অথবা অস্পষ্টভাবে কোথাও প্রচ্ছন্ন রয়েছে।
কমলকুমারের চিঠিগুলো পাঠ করার সময় প্রথমেই যা মনে হয় তা হল, এগুলো শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ডায়েরি নয়; বরং এগুলো এমন এক এপিস্টোলারি ডিসকোর্স, যেখানে ভাষা শুধু বার্তা বহন করে না, বরং নিজেই একটি সেমিওটিক স্ট্রাকচার তৈরি করে। তাঁর ব্যবহৃত বাক্যতন্ত্র, প্রতীকময় বাক্যরীতি, অসমাপ্ত ভাবের অবরোহ এবং হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠা রূপকালংকার— সব মিলিয়ে চিঠিগুলো নিজের একটি টেক্সচুয়াল ইউনিভার্স নির্মাণ করেছে। এই টেক্সচুয়াল ইউনিভার্সই তাঁর কথাসাহিত্যের ভেতরে থাকা স্তর যাকে অনেক সময়ে পাঠক টেক্সটে শনাক্ত করতে পারেন না, কিন্তু যার অনুরণন তাঁর প্রায় সব রচনায় ছড়িয়ে আছে।
এই চিঠিগুলোর একাংশের ভেতরে, অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, এক ধরনের ন্যারেটিভ সাবজেক্টিভিটির প্রতিফলনও দেখা যায়। এখানে লেখকের আমি-সত্তা কোনও স্থির সত্তা নয়; বরং এটি ক্রমাগত পুনর্গঠিত হয় নিজের অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক, শিল্পচর্চা, একাকীত্ব, উদ্বেগ, প্রত্যয় এবং মরমী বোধের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ভিতর দিয়ে।
কমলকুমারের চিঠি বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয় এই কারণে এগুলোর মধ্যে কখনো কখনো রয়েছে ইন্টারটেক্সট যেখানে তাঁর রচনার প্রথম বীজ অনিবার্যভাবে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন তাঁর গল্পে দেখা যায়, গ্ৰামবাংলার বাস্তবতার পাশাপাশি চিত্রময় প্রতীকের বিস্তার, আলো ও অন্ধকারের দ্বন্দ্ব কিংবা চরিত্রের অন্তর্লোক ও অসহায়তা— এসবের উৎসসূত্র খুঁজে পাওয়া যেতে পারে কোনো কোনো চিঠিতে।
সাহিত্য-সংস্কৃতির উত্তাপ, সমকালীন লেখক-পাঠক সম্পর্ক, আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের নানা দিক নিয়ে তাঁর বলিষ্ঠ মতামত কিংবা নিঃসহায় মুহূর্তের স্বীকারোক্তি— সব মিলে এই চিঠিগুলো তৎকালীন সময়ের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি কালচারাল ডকুমেন্ট । বিশেষ করে তাঁর আধুনিকতাবিষয়ক সমালোচনা, অগ্রজ ও সমসাময়িক লেখকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সন্দেহ, কিংবা নতুন লেখার জন্য ভাষাশৈলীর অনুসন্ধান— এসব বিষয়ে লেখা চিঠিগুলো পাঠ করলে স্পষ্ট হয় যে কমলকুমার মূলধারার কোনও নন্দনের সঙ্গে নিজের অবস্থানকে বাঁধতে চাননি। এই কারণে তাঁর লেখা চিঠিগুলো তাঁর নিজের এস্থেটিক অটোনমি রক্ষার সংগ্রামের ভাষিক দলিল।
চিঠিগুলোর কোনো কোনোটিতে দেখা যায় একটি মেটাফিজিক্যাল রিদম— যেন ভাষা কেবল বস্তুকে নির্দেশ করছে না, বরং অস্তিত্বের স্তর ছুঁয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে গভীর নীরবতার ছায়া— যেন প্রতিটি উচ্চারণের নীচে রয়েছে এক অপ্রকাশিত অভিপ্রায়। এই নীরবতা তাঁর সৃজনমানসেরই অংশবিশেষ।
এই সংস্করণে সব মিলিয়ে ৪৫ টি নতুন চিঠি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পত্রপ্রাপকেরা হলেন অরুণ ভট্টাচার্য, সুব্রত চক্রবর্তী, শামসের আনোয়ার এবং বিমান সিংহ। নতুন ও পূর্বগ্রন্থিত মিলিয়ে শুধুমাত্র সুব্রত চক্রবর্তীকে লেখা চিঠির পরিমাণ দাঁড়াল ৫০ টি। এবার পরিশিষ্ট অংশে নতুন দুটি চিঠির ফ্যাকসিমিলি সংযুক্ত হয়েছে । বদলে গেল বইয়ের প্রচ্ছদও ।
অন্তর্ভুক্ত নতুন চিঠিগুলোতে বানান, যতিচিহ্ন, বাক্যবিন্যাস যতটা সম্ভব মূল পাঠ অনুসরন করা হয়েছে। এই কাজটি সম্পন্ন করতে সাহায্য করতে সাহায্য করেছেন কবি, অনুবাদক ও গদ্যকার দেবাশিস তরফদার। নতুনভাবে সংযুক্ত হয়েছে অল্পবিস্তর টীকা, যা পাঠককে প্রেক্ষিত বোঝার ক্ষেত্রে আলোকপাত করতে পারে।
— সম্পাদক
আরও একটি কথা মনে হয়েছে, কমলকুমারের চিঠিপাঠ আসলে এক ধরনের অন্তর্মুখী যাত্রা— যেখানে পাঠকের সঙ্গে লেখকের সংলাপ তৈরি হয়। এই সংলাপ কখনও নির্মম, কখনও আলোকশুভ্র, কখনও বা দ্বন্দ্বপূর্ণ— কিন্তু সবসময়ই তা সত্যনিষ্ঠ এবং ঐতিহ্যআশ্রিত। তাঁর চিঠির ভেতরে রয়েছে যে মানুষ, যে শিল্পী, যে সংশয়ী, যে স্বপ্নদ্রষ্টা— এঁদের সকলের পরিচয় এক বিন্দুতে এসে মিশে যায়।
এই সংকলন তাই শুধুমাত্র কিছু নথির সমাহার নয়; এটি কমলকুমার মজুমদারের শিল্পবোধের ধূসর মানচিত্র, তাঁর ভাষিক বাস্তবতার প্রাথমিক খসড়া, এবং তাঁর নৈঃশব্দ্যের ভিতর জন্ম নেওয়া সৃষ্টিচেতনার বিপুল আর্কাইভ।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি