কবির সাক্ষাৎকার ১ম খণ্ড
(মণীন্দ্র গুপ্ত, আলোক সরকার, উৎপলকুমার বসু, কালীকৃষ্ণ গুহ, দেবদাস আচার্য, গৌতম বসু, সুধীর দত্ত, রামচন্দ্র প্রামাণিক, রাহুল পুরকায়স্থ, পল্লব ভট্টাচার্য)
সাক্ষাৎকারগ্রহণ ও সম্পাদনা : গৌতম মণ্ডল
প্রচ্ছদ : শোভন পাত্র
.............................................................................
ভূমিকা ,: :
একজন আধুনিক কবি তাঁর কবিতায় বলেন যতটা তার চাইতে গোপন করেন অনেক গুন বেশি। এইকারণে আধুনিক কবিতা রহস্যময়, সাংকেতিক এবং বহুস্তরীয়। বিমূর্তও। একজন দীক্ষিত পাঠকের এই ধরনের কবিতার ভিতর প্রবেশ করতে সচরাচর খুব একটা সমস্যা হয় না। কিন্তু যাঁরা ততটা দীক্ষিত নন তাঁরা কীভাবে প্রবেশ করবেন এইসব কবিতায়? রসই বা আস্বাদন করবেন কীভাবে? এক্ষেত্রে, আমার মনে হয়, পাঠককে সাহায্য করতে পারে কবির লেখা কবিতাসংক্রান্ত নিবন্ধ বা আত্মজীবনী। কবির সাক্ষাৎকার, তা যদি সাক্ষাৎকারগ্রহীতার যথাযথ প্রশ্নের কারণে উৎকৃষ্টমানের একটি সন্দর্ভ হয়ে ওঠে তাহলে সেটিও পাঠককে ওই কবির কবিতার অন্দরমহলে প্রবেশ করতে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। করেও।
'কবির সাক্ষাৎকার' গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে উত্তর জীবনানন্দ-যুগের দশজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবির সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দশজনই উৎকৃষ্টমানের কবিতার পাশাপাশি কমবেশি মূল্যবান গদ্যও লিখেছেন, কেউ কেউ এখনও লেখেন।
সাক্ষাৎকারগ্রহীতা একজনই হওয়ায় বিভিন্ন অভিমুখের কথাবার্তার পরিবর্তে প্রায় প্রতিটি সাক্ষাৎকারে একটা সুস্থির চিন্তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলশ্রুতি কবির কবিতাভাবনা ও ডিকশনের পাশাপাশি সাক্ষাৎকারগুলিতে উন্মোচিত হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর চিন্তার সারাৎসারও। নন্দনতত্ত্ব। কিন্তু এই সাক্ষাৎকারগুলির কোনো কোনোটি, অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, অসম্পূর্ণ। কীভাবে? দশটির মধ্যে অন্তত গোটা তিনেক সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে পনেরো কুড়ি বছর আগে। সেসময় কবির কবিতা ও জীবন নিয়ে যেরকম ভাবনাচিন্তা ছিল আজ নিশ্চয়ই সেরকম নেই । কেননা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে যেমন তাঁদের অভিজ্ঞতা বেড়েছে তেমনি প্রকাশিত হয়েছে একাধিক কাব্যগ্রন্থ। গদ্যগ্রন্থও। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সংক্রান্ত প্রশ্ন না থাকায় সাক্ষাৎকারতিনটি বর্তমান সময়ের পাঠকের দৃষ্টিতে অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। কিন্তু একটা সাক্ষাৎকার, তা যত আগেই নেওয়া হোক না কেন, প্রকৃতই কি তা অসম্পূর্ণ হয় ? হতে পারে? পরবর্তীকালে প্রকাশিত গ্রন্থগুলির প্রসঙ্গ না থাকলেও একজন কবির মনের প্রাথমিক গঠনের খুব একটা হেরফের হয় বলে মনে হয় না। তাই আগে নেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিতরেও থাকতে পারে সম্পূর্ণতার আভাস। আলোর ইশারা। এই কারণে আগের স্পিরিট অক্ষুণ্ণ রাখতে সাক্ষাৎকারতিনটির জন্য সংশ্লিষ্ট কবিদের কাছে নতুন করে আর প্রশ্ন করা হয়নি।
সাক্ষাৎকার গ্রহণের কালানুক্রমে সেগুলিকে বিন্যস্ত করার পরিবর্তে কবির বয়সের অধক্রম অনুযায়ী সাক্ষাৎকারগুলি এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
প্রথম সাক্ষাৎকারটি বিশিষ্ট কবি মণীন্দ্র গুপ্তের। এটি নেওয়া হয়েছে ২০১০ সালে। এই সাক্ষাৎকারে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মণীন্দ্র গুপ্তের মূলত কবিতাযাপনের নানান প্রসঙ্গ ও অভিনিবেশের কথা এসেছে। তিনি বলেছেন, 'আমি প্রেরণা আর নির্মাণের ভিতর কোনো পার্থক্য দেখি না।' বলেছেন, 'কবিতার কাছে আমি চাই নিস্তরঙ্গ শান্তি। সৌন্দর্যকে আস্বাদ করতে চাই একা।' সাক্ষাৎকারগ্রহীতার এক প্রশ্নের প্রেক্ষিতে তিনি অন্যত্র বলেছেন, 'আমার মধ্যে চল্লিশের ডিসিপ্লিন কিছুটা রয়েছে, আবার পঞ্চাশের উদ্দামতা রয়েছে।' নিজেকে নিয়ে তাঁর এই পর্যবেক্ষণ, আমার মনে হয়, একশো শতাংশ ঠিক।
আজীবন কবিতাযাপন ও কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আদমসম্মাননা ২০১৩ জ্ঞাপন করা হয়েছিল বিশিষ্ট কবি আলোক সরকারকে। এই উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয়েছিল আদমসম্মাননা সংখ্যা ২০১৪। সেখানে ছিল আলোক সরকারের একটা অকপট সাক্ষাৎকার। এই সাক্ষাৎকারে তিনি 'বিশুদ্ধ কবিতা'র ধারণা যেমন পরিস্কার করেছেন তেমনি বলেছেন,' যা ব্যক্তিত্বময় তাই আধুনিক'। বলেছেন 'অপরিকল্পনার দিকে যাওয়াটাই শিল্প'। কিন্তু শুধু এটুকুই? তিনি বলতে চেয়েছেন কালেকটিভ ম্যান নয়, ইনডিভিজ্যুয়াল ম্যানের কথা। বলেছেন, 'কোনো শব্দেরই কোনো মানে নেই। ভাষাতাত্ত্বিকরাও তাই বলেন। শব্দগুলো ঠিক ঠিক পাশে এলে তবেই একটা মানে তৈরি হয়।'
পাঁচের দশকের আরও একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি উৎপলকুমার বসুর কাছ থেকে হিউমার-এর পাশাপাশি সাক্ষাৎকারটিতে পাই বুদ্ধিদীপ্ত উপলব্ধির কথা। তিনি বলেছেন, 'কবিতা লেখার পর কবিতাটা আর কবির থাকে না।' তাহলে কার থাকে? পাঠকের? তাঁর মন্তব্য 'পাঠক তার বুদ্ধিমতো একটা জগৎ করে নেয়।' উৎপলকুমার বসু কবিতায় কালেকটিভ আনকনশাসনাসকে খুব গুরুত্ব দিতেন। এই প্রসঙ্গে এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত সাক্ষাৎকারটিতে তিনি বলছেন, ' যৌথ অবচেতন। আমাদের অচেতন মন সবকিছু ধরে রাখে। বরফ পড়ার স্মৃতিও মনে থেকে যায়। এই স্মৃতিকে উদ্ধার করতে গেলে সংকেতের দরকার।' সংকেতই তো উৎপলকুমার বসুর কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। চারিত্র্যগুনও।
দেবদাস আচার্যর কবিতার চারিত্র্যগুন আবার সম্পূর্ণ পৃথক। কীভাবে? তিনি নিজেই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'কালক্রম ও প্রতিধ্বনি' থেকেই আমার একটা জেহাদ ছিল। জনজীবনকে সরাসরি কবিতায় আনব।' 'কবিতাকে ড্রয়িংরুমের টেবিল থেকে মাটির ঘড়ের দাওয়ায় নামিয়ে আনার জেহাদ।' এটাও তো একরকম প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। নয় কি? নিজে শতজল ঝর্ণার ধ্বনির অন্যতম সেনাপতি হলেও তিনি মনে করতেন, 'শত জল ঝর্ণার সঙ্গে অঙ্গাগীভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমি জানি যে, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাও একটা প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিতে পারে।'
এর পরের সাক্ষাৎকারটি যাঁর তিনি বেদনাবোধে আক্রান্ত না হলে একটিও কবিতা লেখেন না। ছয়ের দশকের এই কবি কালীকৃষ্ণ গুহ বর্তমান লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অবশ্য বলছেন 'বেদনাবোধ ছাড়াও উৎকৃষ্টমানের কবিতা লেখা সম্ভব।' কীভাবে? তিনি বলছেন, 'এর জন্য দরকার গভীর ও নৈর্ব্যক্তিক জীবনদৃষ্টির।' বিমূর্ততা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, 'বিমূর্ততার মধ্যেই আমাদের সত্যিকারের বসবাস।' 'বোধের জগতে বসবাস করাই তো বিমূর্ততায় বসবাস করা।'
যে দশজন কবির সাক্ষাৎকার এই গ্রন্থে, অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁদের মধ্যে মিথের ব্যবহার সবচাইতে বেশি যাঁর কবিতার মধ্যে দেখা যায় তিনি সুধীর দত্ত। সাতের দশকের এই কবি সাক্ষাৎকারটিতে মহাকবিতা লেখার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। কেমন হবে সেই মহাকবিতা? তিনি বলছেন, 'সে কাব্য ন্যারেটিভ হবে না।' তাহলে? 'হবে ভিতর থেকে গতিময় একটি জটিল ক্রমউন্মোচন।' 'এই মহাকবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র হবে একটি ভাব যা একইসঙ্গে ভারটিক্যাল এবং হরাইজেন্টাল।'
সুধীর দত্তের অভিন্নহৃদয়বন্ধু রামচন্দ্র প্রামাণিক দীর্ঘকাল লেখালেখির বাইরে ছিলেন ঠিকই কিন্তু বর্তমানে তিনি শুধু একজন আলোচিত কবি নন, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার,নাটককার এবং একটি অসামান্য স্মৃতিকথার লেখক। এই দীর্ঘ ও খোলামেলা সাক্ষাৎকারটিতে উঠে এসেছে তাঁর সৃজনের বিভিন্ন দিগন্তের প্রসঙ্গ। তিনি বলেছেন, 'কবিতা আমার কাছে শব্দসৃষ্ট প্রতিমা যাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।' কিন্তু লেখা ছাপা হয়ে গেলে, তিনি জানাচ্ছেন,'পাঠকই সুপ্রিম কোর্ট।'
এরপর যে কবির সাক্ষাৎকার আমরা পড়ব তিনি উত্তর জীবনানন্দ যুগের শুধুমাত্র একজন প্রধান কবি নন, একজন চিন্তক। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আমার নিকটতম বন্ধু। অভিভাবকও। তিনি গৌতম বসু। প্রবাদপ্রতিম পঙক্তি 'এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন' তিনি কীভাবে লিখলেন জানতে চাওয়া হলে সাক্ষাৎকারটিতে তিনি জানান, 'উত্তর কলকাতার, বিশেষ করে চিৎপুর, শোভাবাজার অঞ্চলের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে-ঘুরে এই লাইনটা আমি একদা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। এই কাজটা অন্য কারও দ্বারাও হতে পারত, যদি হত, তাহলে আমার জীবনটাও অন্য খাতে বইত, কবিতার ভূত আমার মাথায় চাপত না।'কবির এক প্রিয় ভাবনা 'ভাষার মৃত্যু ও ক্ষয়' প্রসঙ্গে ওই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'যে ভাষায় মহাকাব্য রচিত হয়, কাব্যের ভার সে-ভাষা বহন করতে পারে না, ভেঙে পড়ে।'
গৌতম বসুর অকালপ্রয়াণের পরে আদম পত্রিকা ও প্রকাশনার উদ্যোগে ২০২২ ও ২০২৩ সালে গৌতম বসু সম্মাননা জ্ঞাপন করা হয়েছিল যথাক্রমে আটের দশকের দুই শক্তিশালী কবি পল্লব ভট্টাচার্য ও রাহুল পুরকায়স্থকে। 'কবির সাক্ষাৎকার' গ্রন্থে এই দুই কবির সাক্ষাৎকারও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
নকশাল আন্দোলন সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে রাহুল পুরকায়স্থ জানিয়েছেন,'নকশাল আন্দোলন ছিল স্বাধীনতার একপ্রকার পুনরুজ্জীবন।' ওই সাক্ষাৎকারেই তিনি বলেছেন,'কবিতার কাছে আমি যা চাইতাম তা হল অর্থহীন জগতের আশেপাশে ঘোরা। অর্থহীনতাকে স্পর্শ করা।' তাঁর সমর্থন যে ব্যাখ্যাতীত কবিতার প্রতি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কবির সাক্ষাৎকার গ্রন্থের শেষ সাক্ষাৎকার যাঁর রয়েছে তিনি ত্রিপুরার নিভৃতবাসী কবি ও ঔপন্যাসিক পল্লব ভট্টাচার্য। দীর্ঘ ও খোলামেলা সাক্ষাৎকারটিতে লেখালেখির প্রসঙ্গ তো বটেই এসেছে আশপাশের নানান অনুষঙ্গও। ভারতবর্ষে বাংলা ভাষার সংকট সম্পর্কে গ্রন্থসম্পাদকের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন, 'দ্যাখো, তুমি যদি বলো, মায়ের সম্পর্কে আপনার অভিমত কী, আমায় বলতে হবে, --- মা তো মা-ই। ভাষার সংকট নিয়ে আমরা যারা মাথা ঘামাই, তাঁরা কারা? ভাষাকে যারা বাঁচিয়ে রাখে, তারা আমরা নই।' পল্লব ভট্টাচার্যের এই কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হই বৈকি।
গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত দশটি সাক্ষাৎকারের মধ্যেই রয়েছে এইরকম অসংখ্য মণিমাণিক্য। পাঠকেরা এই দশটি সাক্ষাৎকার পড়লে তাঁদের লেখালেখি সম্পর্কে তো অবহিত হবেনই, পাশাপাশি সার্বিকভাবে বাংলা কবিতা বিষয়েও একটা মোটামুটি ধারণা পাবেন।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.