পাতায় পাতায় উষারডিহি
মঞ্জিস রায়
প্রচ্ছদ : সৈকত দত্ত
উষারডিহির শরৎ : এক ঝলকে দশাই পরব
শরৎকাল । পুজো এসেছে। অনেকেরই প্রার্থনা মা যেন অসুর দমন করে। অসুরদলনী মাকে ঘিরে তৈরি হয় উৎসব। অথচ এই আনন্দের উৎসব নিয়ে আসে বিষাদের সুর অন্য এক সম্প্রদায়ের কাছে। এরা হল 'অসুর সম্প্রদায়'। মহিষাসুর বধ করে দেবীর জয় এদের কাছে শোক। তাদের মৃত রাজা মহিষাসুরের মৃত্যুকে স্মরণ করে তারা শোক করে। আজও ভুলতে পারেনি সেই পরাজয়ের শোক এই 'অসুর বংশীয়' আদিবাসীরা । দুর্গাপুজোর সময় মহিষাসুরের জন্য শোক পালন করে আদিবাসী সমাজ। চলে দশাই নাচ। পুরুষরা নারী যোদ্ধার ছদ্মবেশ ধারণ করে কান্নার সুরে গ্রামে ঘোরে। এই গানের মধ্যে নাকি লুকিয়ে থাকে এক বিশেষ প্রশ্ন। তাদের বিশ্বাস সেই লুকোনো ধাঁধার উত্তর জানেন একমাত্র হুদ্দুড় দুর্গা।
আসলে এত কথা মনে পড়ল সম্প্রতি প্রকাশিত এই প্রজন্মের লেখক মঞ্জিস রায়ের 'পাতায় পাতায় উষারডিহি বইটি পড়তে পড়তে'। বাঁকুড়ার উষারডিহি গ্রামে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে এই বইটি লিখেছে মঞ্জিস রায়। মঞ্জিস লিখেছে, " রাতের দিকে আমরা উষারডিহিতে গ্রামের পথে চলে গেলাম দশাই পরবের প্রস্তুতি দেখতে। দশাই পরব আসছে।" মঞ্জিসের কথায় " এবার দশাই নাচতে বেরোবে সকলে। এ পরবে পুরুষরা মহিলাদের মতো পোশাক পরে। আফজলদাও বেরোবে। তাই শাড়ি জোগাড় করার কথা"।
আফজল দশাই পরব নিয়ে জানতে চায়।
" আফজলদা বলল, আচ্ছা দাদা আরেকটা জিনিস বলেন তো। সেটা হচ্ছে এই যে পরব, আজকে যেটা হবে কোথা থেকে আসল? বিশুদা বলল, আমরা যখন অসুর বংশের মতন ছিলম, মহিষাসুররা যখন সব মরা হারা খাইত, আমরাও সেইরকম মরা হারা খাইতম । দাদা জানতে চাইল, মরা হারা মানে কী? বিশু হাঁসদা বলল, মরাহারা মানে বুঝছ না ? ও যে গরু মরলে ভাগাড়ে নিয়ে আসে, ওগুলো আমরা খেয়ে নিতম। আর ওই ব্যাং, সাপ যা পেতম সব খেতম। আফজলদা বলল, তা আসলো কেমনে এই পুজোটা? বিশুদাদা বলে, পুজোটা হইল দেবতাদের লিল্যা, দেবতা বুঝিস তো? মহিষাসুর বধ হইল্য। বিজয়ার দিনে তো মহিষাসুর বধ হইছ্যে। তার উৎসবে আমরা সব গ্রামে গ্রামে নাচ গান করে ঘুরলম। ওটার প্রতিবাদে? জিজ্ঞাসা করল আফজলদা, কেন বধ করলা ওইটার প্রতিবাদে? বিশুদা বলল, ওটার বিরুদ্ধে। ওই যে পুরুষগুলোকে পেলে বধ করত। ওই জন্য আমরা সেদিন শাড়ি পরলম মহিলা হয়ে গেলম। শুনে আফজলদা যোগ করল, যাতে বধ করতে না পারে। বিশুদা বললে, মা দুর্গা নিজেও নারী তো । নারীকে বধ করবেক নাই। আমাদের ওই উৎসবে দেখবি সব ছেলেগুলা শাড়ি পরে আসবেক।
কতরকমের গল্প, কতরকমের আখ্যান কত জায়গায় চলে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এটাই আমার মাটি, এটাই আমার দেশ।"