॥১॥
এই বাড়ির বয়স একশ বছরের বেশি নয়। কিন্তু উত্তর কলকাতার একটি বড় গলির গায়ে গেটের ওপাশে দোতলা বাড়িটির চেহারায় যে সাবেকি ছাপ আছে তাতে বোঝাই যায় লক্ষ্মী এঁদের ছেড়ে এখনও পা বাড়াননি। বাড়ির দোতলায় মা সিংহবাহিনীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। যদিও সেই দেবীমূর্তি দর্শনের অধিকার পাড়ার লোকের নেই। বাড়িটির বর্তমান মালিক ছুঁদে উকিল শ্রীযুক্ত পতিতপাবন রায়।
সকাল থেকেই পতিতপাবনের আদালতে বের হওয়া পর্যন্ত এই বাড়ির কাজের লোকজন তটস্থ হয়ে থাকে। পতিতপাবনের বাড়ির চেম্বার, শয়নকক্ষ নীচের তলায়। দিনের মধ্যে একবারই তিনি ওপরে যান এবং সেটা মা সিংহবাহিনীকে প্রণাম করতে। দোতলায় তাঁর স্ত্রী থাকেন পরিচারিকাদের সেবাযত্ন নিয়ে। এঁদের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় পরিমল এবং ছোট প্রবাল থাকে দোতলার এক প্রান্তে, মেয়ে পল্লবী মায়ের ঘরের পাশে। পরিমল আইন পাশ করেছে সদ্য, এখন বাবার সঙ্গে আদালতে বেরুচ্ছে।
প্রতিদিনের মত আজ সকালেও পুরোদস্তুর সাহেবি পোশাকে সজ্জিত পতিতপাবন দোতলায় ঠাকুরঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। সোজা মায়ের মূর্তির কাছে এসে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর হাতজোড় করে চোখ বুজে বলে ওঠেন, 'মা, মাগো, স্ব-ধর্মে রেখো মা। সবই তোমার ইচ্ছে।' প্রণাম সেরে দ্রুত পায়ে নেমে আসেন বাইরের ঘরে। এসেই হাঁক পাড়েন, 'শিবনাথー!' নিমেষের মধ্যে ধূর্ত শেয়ালের মত ঘরে ঢোকে শিবনাথ। পতিতপাবনের ছায়াসঙ্গী। তাকে দেখেই গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করেন পতিত, 'দশটা বেজে দুই। বাড়ির সকলের ঘুম কি ভাঙেনি এখনও?'
শিবনাথ আমতা আমতা করে বলে, 'আজ্ঞে বড়বাবু, বড়খোকাকে দেখে এসেছি, তৈরি হয়েই গেছে। এই এসে পড়ল বলে।'
গজগজ করে ওঠেন পতিত, 'ডিসিপ্লিন, টাইম সেন্সটা আজও বাঙালিদের মধ্যে গড়ে উঠল না। এই জন্যই গোল্লায় যায় এরা। তাকে বলো, তাড়াতাড়ি নীচে নেমে আসতে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।'
শিবনাথ দরজার দিকে পা বাড়াতেই জামার হাতায় বোতাম লাগাতে লাগাতে ঘরে ঢোকে পরিমল। কপালে বেশ কয়েকটা বিরক্তির ভাঁজ ফেলে তার দিকে তাকান পতিতপাবন।
'কটা বাজে?' পতিতপাবনের গলা নিচুতে কিন্তু ধারালো।
পরিমল মাথা নিচু করে থাকে।
'তোমাকে হাজার বার বলেছি বিফোর টাইম নেমে আসতে। আমার কথার গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন বোধ করো না তুমি।' পতিতপাবন চিবিয়ে বললেন।
মাথা নিচু করেই পরিমল জবাব দেয়, 'অন্যায় হয়ে গেছে। আর হবে না।'