বই – বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার : শিশুশিক্ষা, বর্ণপরিচয় ও সেদিনের বঙ্গসমাজ
লেখক - রজত পাল
'১৮৫০ সালে কলকাতায় প্রকাশিত হল 'সর্বশুভকরী পত্রিকা'। কোনো কোনো গবেষক এই পত্রিকাটি মদনমোহন চালু করেছিলেন বলে মনে করেন। আবার অনেকের মতে হিন্দুকলেজের কিছু ছাত্র এটি প্রকাশ করেছিল বলেছেন। শিবরতন মিত্র (১৮৭১-১৯৩৮) জানিয়েছেন যে, মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজনের নামে 'সংস্কৃতযন্ত্র' থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হলেও 'ইহার সম্পাদনভার মদনমোহনের উপর ন্যস্ত ছিল'।
সেদিন সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দুকলেজ একই বাড়িতে পাশাপাশি চলত। দুটি কলেজের সীমানা আলাদা হলেও উভয় কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে নিয়মিত
যোগাযোগ থাকত। মদনমোহনের পৃষ্ঠপোষকতায় এই পত্রিকাটি চালু হয়েছিল বলা যেতে পারে। সে সময়ে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সঙ্গে যুক্ত নন। কিন্তু সেই পত্রিকায় বিদ্যাসাগরের একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছিল। আমাদের অনুমান মদনমোহনের অনুরোধেই বিদ্যাসাগর সেটি লিখেছিলেন। এই পত্রিকাটির সঙ্গে হিন্দুকলেজের কিছু ছাত্র যুক্ত থাকলেও এর মূল প্রাণশক্তি ছিল মদনমোহনের হাতে। কারণ, 'মদনমোহন জজ-পণ্ডিত হইয়া কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া মুর্শিদাবাদ গমন করিলে এই পত্রিকাখানি লুপ্ত হইয়া যায়'। মদনমোহন চলে যাওয়ার পরে মাত্র কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। বিদ্যাসাগর সেই সময়ে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকা সত্ত্বেও এটি টিকে রইল না।
'সর্বশুভকরী পত্রিকা'য় বিদ্যাসাগর এবং মদনমোহনের যে দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, সেই দুটির কিছু অংশ আমরা আলোচনা করেছিলাম বাংলায় গদ্যরূপ নিয়ে কথা বলার সময়ে। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিপক্ষে এবং মদনমোহন নারীশিক্ষার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। এই প্রবন্ধ লেখার আগেই মদনমোহন নারীশিক্ষায় বেথুনসাহেবের একনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে কার্যক্ষেত্রে নেমে পড়েছেন। নিজের দুই কন্যাকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন। নিজে স্কুলে গিয়ে পড়াচ্ছেন এবং বালিকাদের জন্য 'শিশুশিক্ষা' রচনা করে ফেলেছেন।
১৭৭২ শকাব্দের আশ্বিন মাসের সংখ্যাটি ছিল দ্বিতীয় সংখ্যা। তাতে 'স্ত্রীশিক্ষা' নামে প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। প্রবন্ধের শুরুতেই বলা হল,
'এক বৎসরের অধিককাল গত হইল কন্যাসন্তানদিগকে শিক্ষার নিমিত্ত এই মহানগরীতে এবং বারাসাত ও অন্যান্য কতিপয় স্থানে শিক্ষাস্থান সংস্থাপিত হইয়াছে। এই শ্রেয়স্কর বিষয় সর্বত্র প্রচারিত করিবার নিমিত্ত কএকজন মহাত্মা প্রথমতঃ দৃষ্টান্তস্বরূপ হইয়া আপন আপন কন্যাসন্তানদিগকে তত্তৎপাঠস্থানে নিয়োজিত করিয়াছেন। ঐ ভদ্রমহাশয়েরা সর্বদাই মনের মধ্যে এইরূপ প্রত্যাশা করেন যে স্বদেশস্থ সমস্ত ভদ্রব্যক্তিই তাহাদের দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইয়া স্ব স্ব কন্যাগণের অধ্যয়ন সম্পাদনে যত্নপূর্বক প্রবৃত্ত হন।'