বাঘিনী-১
দু'বছর আগে বাঁকা বাগ্ দি যেদিন মারা গিয়েছিল, সেদিন এ সংসারের অমো নিয়মের কোথাও কোনো ত্রুটি ঘটে নি।
মানুষ ধরিত্রীর সন্তান। পাপী-তাপী পুণ্যবান, সব মানুষই নাকি। একটি ক'? মানুষের মৃত্যু পৃথিবীর অদৃশ্য গায়ে একটি ক'রে বয়সের রেখা। একটি হৃৎপিণে ক্রিয়া বন্ধ, জঙ্গম পৃথিবীর এক মুহূর্তের স্তব্ধতা, এসব কথা শোক-গাথায় মানায়।
বাঁকা বাগদির জন্ম শোক, নীতিবিরুদ্ধ ও অসম্মানকর। স্বয়ং ধরিত্রীরও। কারণ বাঁকা বাগদি ছিল ঘোর পাপী। মানুষের দূরের ক
তাই সেদিন পাখি ডেকেছিল। বাতাস বয়েছিল। আকাশের নীলি ছিটেফোটা স্পষ্ট মেঘের ছায়াও পড়েনি। জীবজগৎ কিংবা জড়জগতের কোথ কোনো ত্রুটি ঘটেনি নিত্য অনুষ্ঠানের।
কেঁদেছিল একজন। বাকা বাগ্ দির মেয়ে দুর্গা। যার একটি পোশাকি নাম আছে, পারুলবালা। বিহানবেলা ঘুম ভেঙে যাদের লজ্জা নিবারণ রোজের চি তোলা-কাপড়ের হিসেব তারা পাগল না হলে করে না। বাঁকা বাগ দির ঘরে মে তোলা-নামও সেই রকম হিসেবের পাগলামি ব'লেই মনে হয়! বাপ ডাকতো। ব'লে। লোকে 'বাকার মেয়ে'। আর যে-সব নাম ছিল, সেগুলি গালাগা বিশেষণ।
পোশাকি নাম শুধু একটি কথাই প্রমাণ করে। বাঁকা বাগদির ঘরে কে এক কালে কিছু শখের অবকাশ ছিল।
দুর্গা কেঁদেছিল অসহায় হ'য়ে। কারণ বাপ ছাড়া আর তার কেউ ছিল সংসারে অনেক মেয়ের বাপ থাকে না। কিন্তু সংসারে যে-মেয়ের বিয়ে হয়নি, আঠারো বর্ষার প্লাবনে দেহের দরিয়া অকূল, সে-মেয়ের একটি বাপ দরকার চি সে-বাপ যেমনই হোক। ভবঘুরে বাউন্ডুলে ভিখিরি কিংবা কানা খোঁড়া অ সংসারে এটা একটা নিয়মের সামিল।
তার ওপরে, সে-মেয়ের যদি গায়ের রঙ কটা হয়, চুল পড়ে কোমর ছায় চোখ হয় নিশিন্দা পাতার মতো আয়ত, আর সেই চোখ যদি দীঘির কালো সূর্য-ছটা চলকানো-ঝলকানো হয়। যদি, ভাদরের থির নয়, শাওনের অথৈ জলস্রো
বেগে মেয়ের যৌবন একূলে-ওকূলে যায় ভাসিয়ে। তারও পরে অভাস্ট সেই মেয়ের বিষকটু চোপা শুধুমাত্র স্ফুরিত ঠোঁটের গুণেই যদি উন্টে মিঠে নেশার আমেজ ধরায়। তারও চেয়ে বড় জুর্ভাগ্য যদি সে-মেয়ে হয় মৃত কুখ্যাত বাঁকা বাগদির মেয়ে, তবে সেই মেয়ে কেন শুধুমাত্র শব-ভুক্ শকুনের তীক্ষ্ণ বাঁকা চকুর এক্তিয়ারে নয়?
এ-কথার জবাব দেবার দায়িত্ব কেউ নেবে না এ-দেশে, এ-কথা জানত দুর্গা। পোশাকি পারুলবালা, যদিও সাত-ভাই চম্পার রূপকথার দেশেরই মেয়ে সে।
তাই দুর্গা কেঁদেছিল। কাছে হোক, দূরে হোক, কু হোক, স্ব হোক, ওঝার তুকের সীমানায় ছিল দুর্গা। ওঝা মারা গেছে। চ্যাংমুড়ি কানী বাকা গ্রীবা নিষ্ঠুর অপলক চোখ তুলে আসছে দিগ দিগন্ত ঘিরে। দুর্গ। কেঁদেছিল অসহায় ভয়ে।
বাগ দিপাড়ায় দুর্গার অভাব ছিল না। মেলা-ই না হোক, কয়েকজন ছিল। আইবুড়ো উঠতি বয়সে যারা বাপ-মা হারিয়েছিল। স্বামী হারিয়েছিল যারা অথৈ বয়সে। বাঁকা বংগ দির মত তাদের হয়তো কানাকড়ি ফোঁকা অবস্থাও ছিল না। ছিল হয়ত ছিটে-ফোটা জমি, জলে ভেসে-যাওয়া পিঁপড়ের তৃণকুটোর মতো। কিন্তু মেয়ে ব'লে কথা। মেয়েই বা কেন শুধু। মেয়ে কি মানুষ নয়? পুরুষমানুষ নর। এ-দেশে এটা শুধু কথার কথা নয়, বড় কথা। মন্দ থাকলেই নাকি সংসারে মেয়েমানুষ হ'য়ে জন্মাতে হয়। যেচে করে না, কেঁদে করে। তাই কপাল কোটা শেষ হয় না তার মানুষ-ই। কিন্তু কপালের লিখন মেয়ের ধর্ম নাকি সে কোনোদিন।
কলকাতায় নাকি মেয়েরা অফিস-আদালত চালায়। আরও মুলুকে নাকি তারা যুদ্ধ করে। উড়োজাহাজে উড়ে বোমা মারে। অনেক দূর দূর কত কী করে। হুগলি জেলার এক পাড়াগাঁয়ের বাগ দিপাড়ায় ব'সে, কান পাতলে নিঝুম সন্ধ্যায় নতুন বিজলি রেলগাড়ির বাঁশী শোনা যায় দূর থেকে। কিন্তু সংবাদ, সংবাদ থেকে যায়। এখানে মেয়েজীবনের কপাল কোটার শেষ হয় না।
নগরে আছে আদরেল কোটাল। লম্বরের ছড়াছড়ি। দেউড়িতে আছে বাঘা সেপাই। গায়ে সোনা নেই, দানা নেই, হীরে নেই, জহরত নেই। পুরুষহীনা রাজ্যেশ্বরী তবু অরক্ষণীয়া। শক্ত ক'রে কপাট বন্ধ ক'রেও রাজ্যেশ্বরীর বুকে ত্রাস। ফুঁ দিয়ে বাতি নেভাতে তার দমে কুলোয় না। সারাদিনের এত যে শাসন, কত কষণ, বহু পালন, সে-সব কোথায় যায়। যার চোখের খরায় দুর্জন পোড়ে, স্বজন সুধী স্নেহে, রাজ্যেশ্বরীর কিসের ভয়, কপাট বন্ধ একলা ঘরে?
রাজ্যেশ্বরীর ভয়, সে মেয়েমানুষ। দিন যায়, রাত্রি আসে। এ-ঘর তার দরবার নয়, অমাত্য-আমলার ভিড় নয়, কুর্নিশ নয়। এ-ঘর তার শয়নকক্ষ। রাজ্যেশ্বরী এই ঘরে মেয়েমানুষ। যখন সে এই ঘরে, তখন সেও কপাল কোটে মেয়েমানুষ হ'য়ে।
শুধু কি মানুষেরই ভয়? নিজের প্রকৃতিতেই যে তার বুকের মধ্যে কত ভয়ের লীলা সাজিয়ে রেখেছে থরে খরে।
তাই বাগ দিপাড়ার লোকেরা বলে, মেয়ে ব'লে কথা।
আরও কথা আছে। শুধু ভয়-ত্রাসের কথা নয়। মেয়ে হওয়া যে কত বড় কথা, সে-কথা বলেছে মহাভারতের সেই রাজা। না, মেয়েমানুষকে খোসামোদ-তোষা- মোদের কথা নয়! মেয়ে হওয়ায় কত সুখ, সে-কথা বলে গেছে সেই রাজা।
রাজাটার মনে সুখ ছিল না। রাজ-রাজ্যপাঠ ধনরত্ব, রাজমহিষী সব আছে। রাজার ছেলে নেই। হয় না। রাজা যজ্ঞ করলে, পুজো দিলে আগুনকে। অগ্নি- দেবতার বরে রাজার ছেলে হল একশো। কিন্তু ইন্দ্ররাজ গেল ক্ষেপে। আগুনের পুজো হল, আর ইন্দ্র গেল বাদ? মায়া দিয়ে ছলনা করল রাজাকে। সে-মায়ায় রাজা পাগলের মতো ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে রাজা পথ হারালে। তেষ্টার বুক ফাটতে লাগল। তখন সামনে গেল এক সুন্দর টলটলে সরোবর। রাজা ঝাঁপ দিয়ে পড়ল সেই সরোবরের জলে। তেষ্টা মিটল। কিন্তু হায়! রাজা আর রাজা রইল না। জল থেকে উঠল রাজা এক রূপসী মেয়ে হ'য়ে। সে রূপ, সে যৌবন মুনির ধ্যান ভাঙতে পারে।
দুঃখে রাজার মুখ অন্ধকার। রাজ্যে ফিরে গিয়ে, রাণীকে আর ছেলেদের ডেকে সে বললে, রাজ্য পালন কর, আমি বনে চললুম।
রাজা বন-গমন করলে। আশ্রয় নিলে এক মুনির আশ্রমে। কিন্তু রাজা তো আর রাজা নেই। রূপসী যুবতী মেয়েমানুষ। রূপ দেখে তার মুনির মন টলে গেল। মুনি তাকে ভালবাসল। সেই ভালবাসায়, মুনির ঔরসে মেয়েরূপী রাজার গর্ভে আরো একশো ছেলে হ'ল। রাজা তখন সেই ছেলেদেরও রাজ্যে নিয়ে গেল। নিজের ঔরসজাত ছেলেদের বললে, এই একশো জনও তোমাদের ভাই, আমার পেটের সন্তান। সবাই মিলে রাজত্ব কর সুখে।
দু'শো ভাইয়ে সুখে রাজত্ব করতে লাগল। রাজা ফিরে গেল তার প্রেমিক ঋষির কাছে। ইন্দ্র ভাবলে, হ'ল তো ভাল। অপকার করতে গিয়ে উপকার ক'রে বসে রইলুম? তবে লাগ ভেল্কি ভাল হাতে।
ইন্দ্র ছলনা ক'রে, দু'শো ভাইকে লড়িয়ে দিলে। বললে, তোমরা একদল রাজার ছেলে, আর একদল ঋষির ছেলে। একত্রে তোমরা রাজ্যভোগ করছ কেন? যে-কোন একদল ভোগ কর।
শুনে ছেলেদের ভেদবুদ্ধি জাগল। তারা লড়ালড়ি শুরু করলে। লড়ে, সকলেই মারা পড়ল। তখন রূপসী মেয়ে-রাজ। মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে বসল।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.