চলার পথের চলনদার
মিহির সেনগুপ্ত
এরকম পদ্য বা ছড়া সে যখন রোগশয্যায় শুয়ে শোনায়, আমাদের ভাল্লাগে না। আমার তো লাগেই না। ঢাকুরিয়ার সেলিমপুরি কিনারা থেকে, এই তো কালই না আমি প্রায় অসময়ের গোলাপজাম পেয়ে সবগুলো ওর জন্য নিয়ে গেলাম। সেগুলো কাড়াকাড়ি করে খেলো ওর ভাই মিন্টু আর কে কে যেন? অবশ্য বেশিটা ওই খেলো। বলেছিল, ও কিনা গ্রামের ছেলে, ও জানে এ সব ফলের কথা। আমার নাকের ওষুধের গন্ধ ঝেঁটিয়ে, এই গোলাপজামের সুগন্ধ বড় আরাম দিচ্ছে হে ন্যা ভাই। ওইটুকুই আরাম ওইটুকুই সান্ত্বনা। আমার আনা ফল খেয়ে, সেই ফলের সুগন্ধে, যদি ওর ক্যানসারের মৃত্যু গন্ধ একটু লাঘব হয়! মানুষ আর কতটাই বা আকাঙ্ক্ষী হতে পারে এসব ক্ষেত্রে? একদিন বলল, বাজারের নামীদামি গায়কদের ক্যাসেট তো রোজই শুনছি। শুধুমাত্র তানপুরা সহযোগে কিছু ব্যতিক্রমী রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাবার ব্যবস্থা করতে পার? বললাম, অবশ্য পারি, দুদিন সময় দাও। —সময়টা স্থবিরের কাছে চাও। তুমি ব্যবস্থাটা তো কর। আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু শঙ্কর। সে বয়স পেরিয়ে গেলেও বিয়ে থা করেনি তখনও। তিরিশ বছর বয়সে গান শিখতে শুরু করেছিল সুবিনয় রায়ের কাছে। কিন্তু তার গায়কী নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন করে, আমরা তার গুণমুগ্ধরা, তাকে অমুকের ছেলে তমুকের নাতি বলে গাল পাড়ব। প্রতিষ্ঠা নেই। অথবা প্রতিষ্ঠা শূকরীবিষ্ঠা জেনে সে ও পথ মাড়ায়নি। শুধু আমরা তার গান শুনি, বুঝি বা না বুঝি। বিশেষ করে আমি। তার গান শুনলে ‘কথা ও কাহিনী'র বুড়া রাজা প্রতাপ রায়ের কথা মনে ঝিলিক দেয়—“বরজলাল ছাড়া কাহারো গান ভালো না লাগে তার কাছে।” যখন সবাই সভা ছেড়ে চলে যায়, তখন শুরু হয় প্রকৃত গান। গায়ক গ্রাহক তখন একমন একপ্রাণ শুধু দেহ আলাদা। একথায় যাঁর যা বোঝার বুঝুন। বললাম তাকে, ইলিয়াস মানুষটি এই, তার জন্য একটা ব্যক্তিগত ক্যাসেট যদি করে দিস। আমরা তাকে যমের দুয়োরে কাঁটা দিয়ে নিয়ে আসতে চাইছি। —বলার সময় আমার শঙ্কর শুনল এবং বলল, করব এবং আজকেই। —অতএব নব্বই মিনিটের একটা ক্যাসেট এলো। গান পছন্দ করলাম আমরা দুজনেই। শুধুমাত্র তানপুরা সহযোগে ক্যাসেটস্থ হল গানগুলো এবং পরদিনই সেটা ইলিয়াসকে দিলাম। প্রথম গানটি ছিল বড়ই মোহময়। শঙ্করের আশ্চর্য কণ্ঠে তা আরো মহিমময় হয়ে আবদ্ধ হলো, আর ইলিয়াস তা শুনে তন্ময় হয়ে, তার বাল্যবন্ধু দিলীপকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আমি যদি একটু বেশি রাত ধরে এই ক্যাসেটের গানগুলো শুনি, আশপাশের ঘরের কেউ আপত্তি করবে না তো? দিলীপ অত দুঃখের মধ্যেও সরস জবাব দিয়েছিল, তুমি যদি তোমার ব্যথা কাতরানোর বদলে তাদের সুসঙ্গীত উপহার দাও, তারা বোধহয় তোমাকে আশীর্বাদ করবে। সেই ক্যাসেটটির প্রথম গানটি ছিল,“তোমায় যতনে রাখিব হে, রাখিব কাছে - প্রেম কুসুমের মধুসৌরভে, নাথ, তোমারে ভুলাব হে।” এবং অন্যান্য অনুরূপ গানে ভরা সুগীত ক্যাসেটটি তাকে দিলে প্রথম গানটি শুনেই ওর দুচোখে ধারা বইতে লাগল। ইলিয়াস আদৌ ইমোশনাল প্রকৃতির ছিল বলে এর আগে আমার কখনও মনে হয়নি, অন্তত তার প্রকাশ কখনো দেখিনি। আমি নিজে খুবই ইমোশনাল এবং ওর শয্যাপার্শ্বে যদি কখনো একা বসেছি, আমি কেঁদেছি, আর ও ঠাট্টা করে, মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করেছে, বলেছে, এই ক্যালি নিয়ে সশস্ত্র বিপ্লব করতে গিয়েছিলে? ভ্যালারে আমার কানাইয়ের মা। বলেছিল, এই গান নিশ্চয়ই তুমি গেয়েছ, মিথ্যে বোলো না। বলেছিলাম, আমার বাপের ক্ষমতা নেই এই গায়কিতে গান করা। তার পর শঙ্করের গল্প ওকে শোনালাম। বলল, নিয়ে এসো না একদিন। কিন্তু তা হবার ছিল না। তিন তিন বার শঙ্কর নেত্রালয়ে নিয়ে গিয়েও ওর ডান চোখের রেটিনা ডিটাচমেন্ট-এর সুরাহা করতে পারিনি। প্রথম অপারেশানটাই ভুলভাবে করা হয়েছিল। ফলে ডান চোখটায় পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল ওর এবং বাঁ চোখটায় গ্লোকোমাজনিত সমস্যা। প্রায় রোজই যাই। মাস খানেকের উপর হয়ে গেছে ও এখানে। ব্যথা, ব্যথা, ব্যথা আর ব্যথা। ব্যথা যে ঐ মানুষটার কতটা স্থান জুড়ে তার অনুমান কি আমাদের আছে! একি শুধু হাড়ের মজ্জার, অন্তর অথবা এককথায় তার সমগ্র শরীর তথা মনের ব্যথা? অথবা তার শরীর মন আত্মা অতিক্রম করে এই ব্যথার গতি আরও বিস্তৃত, গভীর এবং ব্যাপক। কিন্তু এসবের কোনো প্রকাশ নেই। প্রকাশ যেটুকু তা তার জীবন, জীবনীশক্তির। বলছে, একজন মানুষের আয়ু হওয়া উচিত তিনশো বছর, নচেৎ কীকরে সে তার সব কাজ শেষ করবে? তুমি কী বলো? সম্ভব? —অসম্ভব আকাঙ্ক্ষা। তবে তিনশো বছরেই কি সবার কুলোবে? মনে তো হয় না৷ খানিকক্ষণ নিঝঝুম পড়ে থাকে। সারারাত জেগে তুতুল পাশের ঘরে হয়ত একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। আমিই অনুরোধ করে অন্য আত্মজনদের একটু বিশ্রাম করতে বা ঘুরে ফিরে আসতে বলেছি। এই দুপুরবেলাটায় দর্শনার্থীরা বিশেষ কেউ আসে না। তরুণ বৈশাখী আর আমি ঘুরে ফিরে এই সময় গেলে ওর পরিজনদের একটু বোধহয় বিশ্রাম হয়, একারণেই এই সময়টা আমরা নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলাম। তাদের লোকবল কম ছিল না। আমরা ওদের সঙ্গে বড় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলাম প্রায় পরিবারের জনেদের মতই। সেটা দীর্ঘ আলাপ পরিচয়ের কারণেই। সাহিত্য শিল্প নিয়ে আলোচনা বা ইলিয়াসের লেখালেখির কারণে তা আদপেই নয়। বিকেল হলে নানান জ্ঞানীগুণীরা, লেখক, সাহিত্যকার, নানান তথ্য-তত্ত্ব, আলোচনা-সমালোচনা শুনতে এবং শোনাতে আসতে থাকলে, আমরা সরে পড়তাম। এই সময়, এমনকি পা কাটা হয়ে যাবার পরেও অনেককে দেখেছি তাঁদের দীর্ঘ দীর্ঘ সব রচনা পাঠ করে শোনাচ্ছেন। এসবেরও নিশ্চয়ই প্রয়োজন ছিল হয়ত তার মনের আরামের জন্য। কিন্তু এ নিয়ে চাপা ক্ষোভও যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু সে বিষয়ে বিস্তারিত হব না। যশোপ্রার্থী লোকের সংখ্যা, অথবা নিজ ভাবনা প্রকাশের, বিশেষত এই লেখার স্টাইল এই, অমুকে আমাকে এই প্রশংসা করেছে ইত্যাদি ধরনের মানুষেরা সংসারে কবেই বা কম ছিল! শুধু একদিন আমার স্ত্রী ক্ষেপে গিয়ে তরুণ আর আমাকে বলেছিলেন, ইলিয়াস ভাই শক্তিমান পুরুষ, ধকল সহ্য করতে পারেন, কিন্তু তুতুলের কথাটা তোমরা কেউ ভাববে না? ও প্রেসারের রোগী, অন্যান্য সমস্যাও ওর কম নেই। সেজন্য ওর নিজেরই ডাক্তার দেখানো দরকার৷ ওর উপর কি এই একশোবার চা কর, হ্যান কর, ত্যান কর, অতিথি আপ্যায়ন করা - এইসব চাপ থাকা উচিত! কথাটা একশ ভাগ সত্য। অসম্ভব শক্ত মনের মহিলা এই তুতুল, সুরাইয়া ইলিয়াস। মহারোগগ্রস্ত স্বামীর সেবাযত্ন এবং নিজের শারীরিক রোগের মোকাবেলা, তার উপর অসংখ্য অতিথি, বন্ধুবান্ধবদের আপ্যায়ন, যেন দশ হাতে ভগবতী। আর মুখে কোনো বিরক্তি নেই, আড়ালেও না। এইসব সময়ে ইলিয়াস যখন ঝিম ধরা কথাবার্তা বলত, বড় কষ্ট লাগত, অবাকও। কারণ, তার কথাবার্তার ধরন একেবারেই আড্ডামেজাজি দেখেছি বরাবর। কিন্তু যখনই ঐ গ্রীষ্মের দীর্ঘ দুপুরে তার সঙ্গে একা হয়েছি, ও ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি একটা অবস্থায়, ওর কথার সুর যেন কীরকম মনে হত। যেন অনেকদূর থেকে কথা বলছে ও, যেন চিনতে পারতাম না তখন। খানিক সময় চুপচাপ, ঝিম মেরে থেকে হঠাৎ ডাকত, মিহির? —হ্যাঁ বলো। --এখানে আর কে আছে? —পাশের ঘরে তুতুল আছে, নীচে পার্থ আর মিন্টু আছে, আর বোধহয় শীতল দাসও আছে। —এখানে আর কেউ নেই তো? —না৷ —আচ্ছা তুমি, তরুণ, বৈশাখী আর তোমার স্ত্রী এরা প্রায় রোজই আসো, তাই না? —রোজ আর কোথায় বল। আসতে তো ইচ্ছে করে। —কেন ইচ্ছে করে কেন? —না এসে স্বস্তি পাই না বলে। —বাংলাদেশে বাড়ি ছিল বলে টান বোধ কর, না? —ঠিক তাই বোধহয় নয়। অথবা খানিকটাতো বটেই। —তুমি মুসলমানদের ক্ষমা করতে পার না, না? যারা তোমাদের বাড়ি, জমি থেকে উচ্ছেদ করেছে, যেমন তোমার ছোটবেলার গল্প তুমি বলছিলে সে সুন্দর সাজানো গ্রাম ছিল তোমাদের, তোমার সেই ছোটবেলা তো ছিনিয়ে নিয়েছে তারা। নয় কি? —তুমি এত কথা বোলোনা তো, ঘুমোও। হিন্দু মুসলমান কাউকেই ক্ষমা করতে পারি না আমি, আবার পারিও। ওসব কথা থাক। আর এরাই আমারে স্বদেশ, এরাই স্বজন— কী করব? —তুমি থাকবে এখন? —হ্যাঁ। আপিস ফাঁকি দিয়ে বা কামাই করে আমি যাই, তরুণেরা আসে, আমার স্ত্রীও আসেন তাঁর স্কুলের ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে অথবা ছুটির দিনগুলোতে। তিনি তুতুলকে একটু সঙ্গ দেন, তাঁদের ইউনিভার্সিটির দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করে ঐ যতটা অন্যমনস্ক রাখা যায়, তার প্রচেষ্টা আর কি! কিন্তু কী নিষ্ফল প্রয়াস আমাদের! —আচ্ছা মিহির। —বলো । —ডা. স্থবির দাশগুপ্ত বলেছেন পা-টা নাকি কোমরের কাছ থেকে কেটে ফেলার দরকার হবে। আচ্ছা তাই যদি হয়, ধরো কেটে ফেলা হলো, তখন আমি কি একটা গোটা মানুষ থাকব? না খণ্ড মানুষ? মানে বলছি যে, এই ঘটনাটা কি বাংলা ভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত? জবাব না দিয়ে বলি—একটা গল্প শুনবে? ছোটবেলার অভিজ্ঞতা? —শুনব। ফালতু না বাখোয়াজি করে গল্প শুনতে ভাল লাগে, বল। —ছোটবেলায় একজন হৃষ্টপুষ্ট লোককে আমি দেখতাম, আমাদের বড় খালের সোঁতা ধরে জাল বাইতে বাইতে নদীর দিকে যাচ্ছে। নামটাও মনে আছে, পরমেশ্বর কৈবর্ত। প্রায় রোজই দেখতাম তাকে। আমি তখন খুব ছোট। মাছ ধরা দেখতে ভাল লাগত বলে খাল পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম। লোকটির চেহারাটি দেখবার মত। বলিষ্ঠ। তামাটে গায়ের রঙ। গলায় কণ্ঠি। হঠাৎ অনেকদিন তাকে দেখি না। লোকটিকে আমার খুব ভাল লাগত৷ প্ৰায় মাস দুয়েক তাকে দেখতে না পেয়ে প্রথমে একটু মন খারাপ, তারপর প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন দেখি খালের কিনারা ঘেঁষে সে হাতড়ে হাতড়ে চিংড়ি মাছ ধরছে। কিন্তু অবাক কাণ্ড সেখানে তার গলা অবধি জল। অতবড় একটা মানুষের গলা অবধি জল খালের অত কিনারে কী করে হয়? একথা তাকে জিগ্যেস করতে সে বলে পা দুটো নেই যে। পরে তীরে উঠে এলো। দেখি, হাঁটুর খানিকটা উপর থেকে তার পা দুটো নেই। বলল, কাঙটে কেটে নিয়েছে। আমরা নিম্নবঙ্গের দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের লোক তো, ওখানের নদীতে মাঝে মাঝে কাঙট আসত। কাঙট কাকে বলে জানতো? —হাঙর, না? —হ্যাঁ। তা জালে খেপ দিয়ে ঝোঁক সামলাতে না পেরে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল। কাঙটের খপ্পরে পড়তে দুটো পাই জখম হয় তাদের ধারালো দাঁতের করাতে। তারপর সেখানে ‘পচ’ ধরতে, শহরের হাসপাতালের ডাক্তার পা দুটো কেটে চিকিৎসা করে তাকে বাঁচায়। কিন্তু এখন সে আর জাল বাইতে পারে না। কৈবর্তের ছেলে, মাছ মারা ছাড়া কোনো বিদ্যে, কর্ম জানা নেই। কিন্তু তারপর আরও বহুকাল ওকে আমি দেখেছি, বুঝলে। ওর দুই পায়ের ঠুণ্ডু নিয়েই সে হাঁটত। জলায় নেমে শাক তুলত, মাছও ধরতো, ওর জাত ব্যবসার কর্ম ছিল যা। এমনকি ডুব সাঁতার কেটে চিতল মাছের ঘোলায় হানা দিতেও দেখেছি তাকে। আরও অনেক কাজই করত সে। শুধু জাল বাইতে না পারার দুঃখটা ভুলতে পারত না। এছাড়া সব সময়ই সে আগের মতই হাসিখুশি থাকত। কারুর উপরই নির্ভর করতে চাইত না আদৌ। সবাই তাকে ভালবাসত। সাহায্য করতে চাইত নানা ভাবে। কিন্তু সে তা নিতে রাজি হত না। একদিন সে একটা বাওড়ে পড়ে। উঠতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। একজন পথচলতি লোক হাত বাড়িয়ে দিলে ও বলেছিল, ছাড়ইয়া দেন, নিজেই পারমু। —তারপর? তারপর, সে তখন আইয়ুব শাহী সময়। বুঝে দেখ কতদিন আগের কথা বলছি। মানুষের বাক স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই। কোনো কিছুতেই তো তখন মুখ খোলা বারণ, জানই তো। গ্রাম গাঁয়ে অবশ্য তাতে কিছু তেমন এসে যেতো না। তবে পরমেশ্বর কিছু লেখাপড়া জানত বলে, অনেক খবরটবর রাখত। ফলে সে ঘোরতর আইয়ুব বিরোধী। গানটান বাঁধতে জানতো লোকটা। একদিন দেখি, গা হাত পায়ের কাদাফাদা ধুয়ে সে দিব্য ধোপ দুরস্ত আর বাজারের মাছপট্টির কাছে একা গাছ তলায় বসে সে গান গাইছে, তারই বাঁধা গান— দাঁত যুদিবা ভাঙ্গে ক্যারোর কান দিয়া বাইর করো। তা যদি না পারো তবে গলায় বাজইয়া মারো। মুখ খুলিতে মানারে ভাই মুখ খুলিতে মানা। আইয়ুব চাচার শাসন যেন আজব চিড়িয়া খানা। কোথায় যামু বলরে ভাই কোথায় পামু ঠাঁই পিছনে রইয়াছে সিপাই সামনে সমুদ্দুরাই। সবাই জিজ্ঞেস করে, পরমেশ্বর, তোমার কী অইছে? তুমি এরহম কর ক্যান? পরমেশ্বর বলে— খাল বিল পুষ্করিণী হুগাইয়া যায় খাওন দাওন বলো কোনহানে পাই? যখন আছিল কাল তখন ছেলাম বেখেয়াল অহন খাল শুগাইয়া চামসি দিলে কে দেবে আথাল। বলো বলো তবে আমার আথাল কী কোথায় থিহা এড ওডা আমি আইন্যাদি এইসব গল্পে ইলিয়াস যেন অনেক গভীর ঘুম ঠেলে জেগে ওঠে। বলে এইসব মানুষদের কথা তোমার এখনও মনে আছে? এইসব আমাকে আগে শোনাতে পারনি? এখনই বা শোনাচ্ছ কেন? অথবা এই গল্প আমার নিশ্চয়ই শোনা উচিত। তোমার পরমেশ্বরকে নিয়ে একটা গল্প লিখব। —আমি যেটা বললাম, সেটা কিন্তু গল্প নয়। আমি তাকে সত্যি দেখেছি। তারপর শোনো। জানোই তো সে সময় বুনিয়াদি গণতন্ত্রীদের দাপ কী রকম। তোমাদের শহর নগরের কথা আমি জানি না। তবে গ্রামাঞ্চলে এদের দৌরাত্ম্য নেহাত কম ছিল না। পরমেশ্বর এইরকম গান গেয়ে যায়। বাজারে দাঁড়িয়ে দশে ধম্মের দুঃখের কথা, বুনিয়াদি গণতন্ত্রীদের মস্তানির কথা, দাঙ্গার কথা, সরবে বলে, কখনো কথকতায়, কখনো ছন্দে সুরে। একারণে, একাধিক দিন তাকে ধমক খেতে হয়েছে, চড়টা চাপড়টাও যে না খেয়েছে এমন নয়। কিন্তু সে অদম্য। শেষে একদিন দেখা গেল সে আর বাজারে দাঁড়িয়ে গান গাইছে না। দু-তিনদিন বাদে বড়খালের উজানে একটা ছৈলা ঝোপের অন্দরে তার দেহটা পাওয়া গিয়েছিল। সবাই বলল, পা নেইতো তাই লতাপাতাশেকড়ে জড়িয়ে আর উঠতে পারেনি। অন্য সম্ভাবনার কথা কারু মুখে শোনা যায়নি। কাহিনিটা শুনে ইলিয়াস বলল, আমার এই 'পাটা কাটা হলে, অন্যটা তো থাকবে, আমি লতায় পাতায় ছৈলা ঝোপে আটকে যাব না।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.