সময় ভ্রমণ
(দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা)
সৌমিত্র ঘোষ
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত, শুভশ্রী দাস
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
দার্জিলিং পাহাড় এবং পাহাড়ের নিচের তরাই অঞ্চলের নিসর্গের খোঁজ করা হচ্ছে এই বইতে। খোঁজ বলতে অসংখ্য পুরোনো-নতুন বইপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ, সেই সঙ্গে নানান রকমের ও নানান জনের স্মৃতিভান্ডার খুঁড়ে দেখা, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া। জায়গা বলতে নিছক স্থান নয়, সময়ও। ঔপনিবেশিক ও প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়পর্ব থেকে দার্জিলিং পাহাড়ের ও সংলগ্ন সমতলের ইতিহাস ভূগোল সমাজ কীভাবে বদলেছে, এখনো বদলাচ্ছে, তার বিশদ সন্ধান নেওয়া, সে উদ্দেশ্যে এই সময়ে ওই সময়ে পাড়ি দেওয়া। পাড়ি দিতে দিতে যা এখন আছে, এবং যা নেই, থাকা না থাকার এই দ্বিবিধ জ্যামিতিকে প্ৰশ্ন করা। প্রশ্ন আমাদের দেখার, মুগ্ধতার, ভালো খারাপ লাগার ধরন নিয়েও। প্রকৃতি, নিসর্গ, নিসর্গ প্রকৃতি ইতিহাস ভূগোল সমাজ নিয়ে বিভিন্ন পাঠ ও দেখা, সময়ভ্রমণ বলতে আসলে এই সবের মধ্যে বেড়ানো, বেড়াতে বেড়াতে বেড়ানোর গল্প বলা এবং শোনা। দার্জিলিং নিয়ে প্রত্যেক আগ্রহীজনের অবশ্যপাঠ্য, অবশ্যশ্রাব্য। দার্জিলিংয়ের মানুষ, চা বাগান ও শ্রমের ইতিহাস এর আগে এত যত্ন করে কোথাও লেখা হয়নি।
------------
"পেশক বা পাশোকের কথা হচ্ছিল। পুরোনো বনের জায়গায় এখন সেগুনবাগান, অন্য গাছ একটাও নেই। এক বর্ষাকালটা ছাড়া বাকি সময়টা পেশকে ইদানীং রঙও ধরে না সেরকম। বৃষ্টির জল পেলে সেগুনপাতা জ্যান্ত হয়ে ওঠে নীচের জমিতে এক-আধটা ঘাস গজায়, কিছু মাটিছোঁয়া লতাগুল্ম, কিছু ছোটো গাছ। বৃষ্টি না থাকলে সবটা শুকনো, বিবর্ণ, ন্যাড়া।
সেগুন গাছ মাটি থেকে এত জল টানে যে অন্য উদ্ভিদ সেগুনবাগানে জন্মাতে পারে না। পেশকের প্রথম চড়াই শেষ করলে পেশক চা বাগান, গ্রাম। ওই জায়গাটায় একটা টিলার ওপরে পেশকের পুরোনো বাংলোটা ছিল। পারিলিং থেকে কালিম্পঙ, সিকিম, তিব্বত যেদিকেই যাওয়া হোক, পেশক বাংলোটা যাত্রাবিরতির পছন্দসই জায়গা ছিল। ফিকে সবুজ কাঠের পুরোনো বাড়িটাকে আমিও দেখেছি, স্বপ্নের মতো মনে পড়ে। অথবা দেখিনি।
কিংবা চোখ দিয়ে না হলেও মন দিয়ে দেখেছি। কোথায় চোখের দেখা শেষ আর মনের দেখা শুরু, কে বলতে পারে!
পেশকের বন বা বাংলো কিছুই এখন নেই। বন কাটা হয়ে গেছে কোনকালে, বাংলোটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রথম গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময়। অথচ দিব্যি দেখতে পাই, টিলার ওপরে পেশকের সবুজ কাঠের বাংলো, তার সামনের ঘন বনের মধ্য দিয়ে সরু পাকদণ্ডী তিস্তায় পৌঁছেছে। সেই পাকদণ্ডী দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একের পর এক মাল বোঝাই খচ্চরের সারি, ভুটিয়া-নেপালি-শেরপা কুলির দল, মালের বোঝায় ঝুঁকে পড়া। তার পিছনে কি সামনে ঘোড়ায় চেপে সাহেবদের দল, অভিযাত্রী, রাজপুরুষ, সৈন্য, পবর্তারোহী। কে নেই সেখানে! জোসেফ ডাল্টন হুকার, যিনি প্রথম দার্জিলিং আর সিকিমের গাছপালার দীর্ঘ তালিকা বানিয়েছিলেন; এল এ ওয়াভেল, যিনি পায়ে হেঁটে সিকিম ও দার্জিলিং হিমালয়ের প্রায় সবকটা উঁচু পাহাড়ে ঘুরেছিলেন, লামাইজম বা তিব্বতি মহাযান বৌদ্ধধর্ম নিয়ে প্রামাণ্য বই লিখেছিলেন, বারবার মনে করিয়েছিলেন এলাকার পুরোনো লোকজন, গাছপালা, জঙ্গলকে বাঁচিয়ে রাখার কথা।
পেশক থেকে পথ উঠে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ওঠার সময় ডানদিকের ঢাল নেমে যাচ্ছে। রংগীতে, বাঁদিকের ঢাল তিস্তায়। চা এবং দুধ পুড়িয়ে তৈরি করা ছোটো ছোটো গোল গোল প্যাঁড়ার জন্য বিখ্যাত লগড় চা বাগান ছাড়িয়ে আরো খানিক চড়াই উঠলে একলা নিঃঝুম লামাহাটা, যেখানে এখন পর্যটনের ঢল, ফলে রাস্তার পাশের বাড়িগুলো বড় এবং পাকা, বড় বড় পাইন গাছের গুঁড়ি নীল সাদা, গুঁড়ি ঘিরে বাঁধানো সিমেন্টের বেদী, এখানে ওখানে বাচ্চাদের খেলা করবার ও বড়োদের ছবি তুলবার মতো রঙে স্লিপ, বেঞ্চি, এটা সেটা।
এই রঙিন নতুন লামাহাটা তৈরি হবার আগে পুরোনো লামাহাটা ছিল সত্যিকারের মেঘের দেশ। ওই পথ দিয়ে যেতে আসতে কতবার যে দেখেছি পাইনগাছের গুঁড়িতে গুঁড়িতে লতিয়ে উঠছে পুরু সাদা মেঘ, এত ঘন যে গাছের মাথা দেখা যায় না। পাইনবনের পাশে সেই মেঘের বাগানে লম্বালম্বি টাঙানো আছে রঙিন বৌদ্ধ প্রার্থনা পতাকার সারি, লাল নীল হলুদ সবুজ, সে পতাকায় লেখা 'ওম মণিপদ্মে হুম'।"
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.