ছায়া ঢাকা মন

(0 পর্যালোচনা)

লিখেছেন:
সমরেশ বসু
প্রকাশক:
দে'জ পাবলিশিং

দাম:
₹150.00

সংস্করণ:
পরিমাণ:

মোট দাম:
শেয়ার করুন:
প্রকাশক
দে'জ পাবলিশিং
১৩, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট, কলকাতা -৭০০০৭৩
(0 ক্রেতার পর্যালোচনা)

শমীকের চোখে অসহায় বিস্ময়, সারা মুখের গাম্ভীর্যে একটা বিক্ষোভের ছায়া স্পষ্ট। ফর্সা কাঁচা মুখ, এখনো ব্লেডের ছোঁয়া লাগেনি। অথচ পাতলা নরম গোঁফ দাড়ি উঠেছে। সেখানে এখনো রেজারের টান পড়েনি বলেই, ওর মুখ যেন আরো কচি মনে হয়। যেমন কচি লাউডগার গায়ে নরম শুঁয়ো, তার কচি ত্বককে আরো কোমল করে তোলে, সেইরকম। ডাগর চোখ, চোখা নাক আর ওর মায়ের মতোই পুষ্ট ঠোঁট, কিন্তু স্থূল না। ও ওর বাবার মতন উজ্জ্বল গোরা না, মায়ের মতন ফর্সা। যাকে বলা যায় উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। ওর সবই প্রায় ওর মায়ের মতো। কেবল কপাল চিবুক আর কান দুটি বাদে। সে সব নাকি ওর বাবার মতো হয়েছে। বাড়িতে ওর চেহারা নিয়ে এরকম আলোচনাই হয়। স্বাস্থ্যের দিক থেকেও, সেই কথাটা ওর শরীরে ছড়ানো, নরানাং মাতুলাক্রম। ওর বাবা মাঝারি দৈর্ঘ্যের মানুষ। ও হয়েছে মামাদের মতো লম্বা।

শমীককে বাড়িতে সবাই টুপু বলে ডাকে। মা বাবা দুজনেই। ওর ছোট বোন কেয়া অবশ্যি দাদা বলে। ওর ওপরের দিদি খেয়া, যার বিয়ে হয়েছে বছরখানেক আগে, স্বভাবতই সেও টুপুই বলে। বাইরে ওর বন্ধুরাও ওকে টুপুই বলে। নিতান্ত অধ্যাপকেরা বা কম মেলামেশা করে, এরকম ছেলে- মেয়েরা শমীক বলে ডাকে। ওর বয়স এখন আঠারো-আঠারো পেরিয়ে এই মাসেই উনিশে পড়েছে।

বসবার ঘরে, বড় সোফায় ওর বাবা বসে আছেন। শমীক তাঁর মুখোমুখি আর একটা সোফায়। ঘরের অন্য দিকে ডিভানের ওপরে ওর মা বসে, উল বুনছেন। বাবার মাথার চুলে পাক ধরেছে। বয়স পঞ্চাশের মতো। পায়জামা পাঞ্জাবির ওপরে চাদর জড়ানো। প্রাতঃরাশ সেরে, আর একবার কফি নিয়ে বসেছেন। মায়ের চুলে এখনো পাক ধরেনি, বয়স চল্লিশের ঊর্ধ্বে, দেখায় আরো কম। মাথার পাতলা চুল শ্যাম্পুতে ফোলানো। খোলা চুল, ঘাড়ের কাছে, শাড়ির আঁচল জড়িয়ে ঢাকা। ওঁর গায়ে একটা রঙিন ফুলের এমব্রয়ডারি করা কালো উলেন স্কার্ফ। শাড়িটি ধাতব ধূসর রঙের।

প্রসাধন করেননি, তবু হঠাৎ দেখলে মনে হয় করেছেন। ক্রিম ঘষা মুখে বোধহয় পাউডারের পাফ বুলিয়েছেন। বোঝা যায়, উনি এখনো বাইরে বেরোতে হলে, নিয়মিত প্রসাধন করেন। উনি উল বুনতে বুনতে পিতা পুত্রের কথা শুনছেন। একবার স্বামীকে দেখছেন, আর একবার টুপুকে। মাঝে মাঝে চোখ নিচু করে বুনে যাচ্ছেন।

শমীকের পরনে সবুজ বোতল রঙের ট্রাউজার। সর্ষে ফুল রঙের শার্টের ওপরে হাইকলার পুলওভার। কপালের ওপর অবিন্যস্ত চুলের গোছা পড়ে আছে। এখন ওর গম্ভীর মুখে বিক্ষোভের ছায়া স্পষ্ট। চোখের দৃষ্টিতে অসহায় বিস্ময়। ওর বাবার মুখও গম্ভীর, কিন্তু রাগের কোনো ছাপ নেই। তিনি শমীকের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন না। হাতের সামনে ইংরেজি সংবাদপত্রের ওপরে চোখ রেখেই, আগের কথার সূত্র ধরে বললেন, 'হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলারের নীতির সঙ্গে আমি এক মত।'

শমীক ঠিক ঝেঝে নয়, যেন আলাপের সুরে বলল, 'তুমি বলতে চাও, ভাইস-চ্যান্সেলার বা ইউনিভার্সিটি, আমাদের এডুকেশনের কোরাপশনের জন্য মোটেই দায়ী নয়?'

শমীকের বাবা শরৎ একবার ছেলের মুখের দিকে দেখলেন। বললেন, 'এডুকেশন ব্যবস্থার কথা হচ্ছে না। পরীক্ষায় টোকাটুকির কথা হচ্ছে। তার জন্য ইউনিভার্সিটি বা ভাইস-চ্যান্সেলার দায়ী নন। তাঁরা বলে দেননি, ছেলেমেয়েরা যদৃচ্ছা গণ টোকাটুকি চালিয়ে যাক। আর এই টোকাটুকি বন্ধ করার জন্য, পরীক্ষা বাতিল করে দিয়েও তাঁরা ঠিক করেছেন। এই জন্য বিক্ষোভ দেখানো অন্যায়। তুমি সেই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে থাকবে, আমার খুব খারাপ লাগবে।'

শমীকের উজ্জ্বল শ্যামল কাঁচা মুখে, অসহায় বিক্ষোভের ছায়া আরো স্পষ্ট হল। বলল, 'কিন্তু আমরা যারা টুকিনি, খেটে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছি, তাদের কী হবে?'

শরৎ নির্বিকার মুখে বললেন, 'তোমাদের বন্ধুদের পাপের বোঝা তোমাকেও বইতে হবে।'

শমীক সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, 'কারা আমার বন্ধু, কাদের কথা বলছ তুমি? ওই সব নোংরা শয়তান নকলবাজ ছেলেরা আমার বন্ধু?' শরৎ বললেন, 'আমি ঠিক সে অর্থে বলিনি। তারা সবাই হয়তো তোমার বন্ধু নয়, কিন্তু তোমরা সকলেই, একই শ্রেণির পরীক্ষার্থী। সেই হিসাবে বলছি, এ পাপের বোঝা তোমাদেরও বইতে হবে।'

'কেন?' শমীকের মুখে অসহায় রাগ এবং বিস্ময় এবার আরো তীব্র হয়ে উঠল এবং সেই তীব্রতা এতই যে, ওর চোখ ছলছলিয়ে উঠল। বলল, 'কেন, বল বাবা। চোর জোচ্চোরদের শায়েস্তা করতে না পেরে, শেষটায় সব শাস্তি আমাদের ওপর। তাহলে কি বলতে হবে, নিয়ম নীতি বলে কিছু নেই?'

শমীকের চোখে সত্যি জল দেখা দেয়। ওর মা মৃন্ময়ী বলে ওঠেন, 'টুপু, চুপ কর। কী হবে এমন কথাবার্তা বলে?'

মৃন্ময়ী একবার স্বামীর দিকে তাকালেন। স্পষ্টতই তাঁর চোখে একটু অভিযোগের ছায়া। শরৎ সেদিকে দেখলেন না, শমীকের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। 'বললেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিশ্চয় পড়েছ, "এ তোমার পাপ, এ আমার পাপ।" আমি সেই কথাই বলছি।'

শরৎ যেন তাঁর কথা ঠিক যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারলেন না। শমীক বলল, 'আমার কোনো পাপ নেই বাবা।'

শরৎ কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। একবার মৃন্ময়ীর দিকে তাকালেন, তারপর দেওয়ালের ঘড়ির দিকে। আবার বললেন, 'আমি তোমার পারসোনাল পাপ পুণ্যের কথা বলছি না। আজ আমরা যে সমাজ আর শিক্ষা ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছি, তার জন্য আমরা সকলেই দায়ী। ভালো মন্দ সব আমাদের নিজেদের।'

শমীক বলল, 'তার মধ্যে তাহলে ভাইস-চ্যান্সেলারও আছেন?' শরতের ভুরু কুঁচকে উঠল, রাগতভাবে বললেন, 'তার মানে কী? আমি দেখছি, যেভাবেই হোক, তুই ভাইস-চ্যান্সেলারকে টেনে আনছিস। কেন?'

'কেন না, আমরা যারা খেটে পরীক্ষা দিয়েছি আমাদের ক্ষতির জন্য উনিই সব থেকে বেশি দায়ী। উনি একটা ডিকটেটরের মতো-।'

'শাট আপ।' শরৎ ধমক দিয়ে উঠলেন, 'ওসব তোমাদের মুখস্থ বুলি আমি শুনতে চাই না। যা করা হয়েছে, ঠিকই করা হয়েছে। এসব নিয়ে তোমার সঙ্গে আমি আর কথা বলতে চাই না। মোটের ওপর, এ নিয়ে বিক্ষোভ আর অ্যাজিটেশন, এসব করা চলবে না।'

মৃন্ময়ী বললেন, 'টুপু তো বিক্ষোভ দেখাতে যায়নি।'

এই বইয়ের জন্য এখনও কোন পর্যালোচনা নেই

বই সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা (0)

প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য

অন্যান্য প্রশ্নাবলী

কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি

Boier Haat   |   © All rights reserved 2023.