চিত্রনাট্য নির্মাণে এবং প্রকাশভঙ্গির দিক দিয়ে সত্যজিৎ রায়কে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় সম্ভবত পড়তে হয়েছে রবীন্দ্র উপন্যাস 'ঘরে-বাইরে' নির্মাণের ক্ষেত্রে। এটা লক্ষ্যণীয় যে, রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ উপন্যাসটিই নিখিলেশ, বিমলা এবং সন্দীপ এই তিন চরিত্রের জবানিতে বলা হয়েছে, তিনজনের প্রকাশভঙ্গি পৃথক এবং স্বতন্ত্র। এছাড়া মূল উপন্যাসে সেই অর্থে সংলাপ প্রায় নেই বললেই চলে, সত্যজিৎ এই দুটো অচলচ্চিত্রীয় ব্যবধান খুব নিপুণতায় দূর করেছেন। এটা ঠিক মূল উপন্যাসের ত্রিমাত্রিক প্রকাশভঙ্গি যা
তিনজন চরিত্রের টেনশনের মধ্যে ধরা পড়েছে তা সত্যজিতের চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত। তবুও চলচ্চিত্র অনুসারী সাহিত্যের দিক দিয়ে এটি দিক-নির্দেশ বিশেষ। গৌতম ঘোষের 'অন্তর্জলী যাত্রা' সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ এক দিক দিয়ে স্বতন্ত্র। কমলকুমার মজুমদারের লেখা ৬০-এর দশকের এই উপন্যাসটি এক সময়ে বুদ্ধিজীবী মহলে। প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছিল, তার একেবারে আলাদা গদ্যস্থাপত্য, প্রচণ্ড কঠিন বাক্যবদ্ধ এবং দৃশকল্পের রূপকতার জন্য। কোনো চিত্রপরিচালকই এই মহতী উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার কথা চিন্তাই করেননি, উপন্যাসটির প্রচণ্ডরকমের বেশি সাহিত্যগুণের জন্য। গৌতম ঘোষ এই সাহিত্যকর্মটিকে রূপ দিয়ে বার্গম্যানের 'Film has got nothing to do with Literature' এই কথাটির সজোর প্রতিবাদ করলেন। মৃণাল সেন সত্যজিৎ রায়ের সমসাময়িক হয়েও বার্গম্যানের ওই কথানুসারী, অন্তত তাঁর সৃষ্টিতে, তার প্রধান কারণ হয়তো মৃণাল সেনের প্রথাভাঙার প্রবল তাড়না, যা সাহিত্যের কাঠামোয় কিছুটা অসম্ভব, তবুও মৃণাল সেন বনফুল-এর ভুবন সোম' থেকে রমাপদ চৌধুরীর 'খারিজ' থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটোগল্প তেলেনেপোতা আবিষ্কার অবলম্বনে 'খণ্ডহর' এবং শেষ অমলেন্দু ভট্টাচার্যর 'আকালের সন্ধানে' এই অনিশ্চিত পরিক্রমায় দেখিয়েছেন কীভাবে সাহিত্যের সরলরেখায় চলেও চলচ্চিত্র করা যায়। ক্লাসিক সাহিত্যের চলচ্চিত্র মানসে সত্যজিৎ ছাড়া যিনি সবচেয়ে সাবলীল তিনি তপন সিংহ, মনোজ মিত্রের 'সাজানো বাগান' থেকে 'বাঞ্ছারামের বাগান' এবং জরাসন্ধের 'লৌহকপাট' চলচ্চিত্র- ইতিহাসে সাহিত্যের গর্বিত পদচারণা। এছাড়া অন্যান্য চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে পূর্ণেন্দু পত্রীর রবীন্দ্র-গল্প থেকে 'স্ত্রীর পত্র', দিলীপ রায়ের সমরেশ বসুর উপন্যাস থেকে 'অমৃতকুম্ভের সন্ধানে', ঋত্বিক ঘটকের নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস থেকে 'কোমলগান্ধার', গিরীশ কারনাড-এর মৃচ্ছকটিকম থেকে 'উৎসব', মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর 'আজকাল পরশুর গল্প' এবং 'সরীসৃপ থেকে নবেন্দু চট্টোপাধ্যায়-এর চলচ্চিত্র, এইসবও সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রে সেতুর এক-একটি বর্ণময় অধ্যায়।
বই- সিনেমায়া অন্য প্রেমের ২৪ ফ্রেম
লেখক- সুব্রতকুমার রায়