হুগলি একটি বহু প্রাচীন জনবহুল জনপদ। অতীতে এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর। গঙ্গার শাখানদী ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে এর অবস্থান।
রামায়ণ ও মহাভারতে বঙ্গ ও সুক্ষ নামের উল্লেখ আছে। ভাগীরথীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত ভূভাগ ‘সুক্ষ’নামে পরিচিত ছিল। পরে এই স্থানটির নাম হয় দক্ষিণ রাঢ়। এই রাঢ় দেশের অধিপতি ছিলেন সিংহ বাহু। তাঁর রাজধানী ছিল সিংহপুর (সিঙ্গুর)। প্রাচীনকালে বঙ্গ বলতে পূর্ববাংলা ও রাঢ় বলতে পশ্চিম বাংলাকে বোঝাত৷ ত্রয়োবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গ ও রাঢ়দেশ একত্রে বাংলাদেশ (অবিভক্ত) নামে পরিচিত হতে থাকে।
ইউরোপের পর্তুগাল নাবিক ভাস্কো-ডা-গামা সমুদ্রপথে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছায় ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং ফিরে গিয়ে সমৃদ্ধিশালী ভারতের খবর পৌঁছে দেয় বিশ্বের দরবারে। ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজরা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে প্রথম বঙ্গদেশে আসে। ১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দে এ দেশের শাসকশক্তির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তারা ভাগীরথীর শাখা সরস্বতী নদীর তীরবর্তী সপ্তগ্রাম বন্দরে বাণিজ্য শুরু করে।
নদীপথে সপ্তগ্রাম বন্দরে যাতায়াতের সময় পর্তুগিজরা ভাগীরথীর তীরে হোগলা গাছের জঙ্গল ঘেরা গ্রাম্য জনপদ দেখে ঐ এলাকার নাম রাখে হুগলি। মুসলমান লেখকদের রচনাতেও প্রাচীন হুগলি জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫৯৬ খ্রিষ্টাব্দে রচিত আবুল ফজলের “আইন-ই-আকবরী” গ্রন্থে হুগলি নামের উল্লেখ আছে ।
পলি জমার কারণে সরস্বতী নদীর নাব্যতা নষ্ট হয়। ফলে সপ্তগ্রাম বন্দর ছেড়ে পর্তুগিজরা ভাগীরথীর তীরস্থ হুগলিতে এসে নদী বন্দর গড়ে তোলে। ১৫৭৯ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন পেড্রো ট্যাভারেস আগ্রায় এসে সম্রাট আকবরের সাথে দেখা করে বাণিজ্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। হুগলি নদী বন্দর কালক্রমে বঙ্গের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়।
বাণিজ্যের সাথে সাথে পর্তুগিজরা হুগলিতে ঘাঁটি স্থাপন করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করলে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে তদানীন্তন বাংলার শাসনকর্তা কাশিম খাঁ জুইনি ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধে পর্তুগিজদের ঘাঁটি ধ্বংস করেন। পরে অবশ্য সম্রাট শাহজাহান ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজদের বসবাসের জন্য ব্যান্ডেলে জমি দেন।
বিদেশিদের মধ্যে ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে ওলন্দাজ ও ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা সম্রাট শাহজাহানের অনুমতি নিয়ে হুগলি বন্দরে ব্যবসা শুরু করে। কয়েক বছর বাণিজ্য করার পর ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ওলন্দাজরা হুগলি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী চুঁচুড়ায় চলে আসে।
তবে পরবর্তীকালে চুঁচুড়া ইংরেজদের অধিকারে আসে। ১৬৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসিরা চন্দননগরে বাণিজ্য-বসতি স্থাপন করে এবং ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের পর ফরাসিরা চন্দননগর ছেড়ে যায়। ১৭২৩ খ্রিষ্টাব্দে বেলজিয়ানরা ভদ্রেশ্বরে বসতি স্থাপন করে অল্পদিনের জন্য ব্যবসা করে। আর এক বিদেশি শক্তি জার্মানরা ভদ্রেশ্বরে এলেও দীর্ঘদিন তাদের পক্ষে বাণিজ্য করা সম্ভব হয়নি। দিনেমাররা প্রথমে ভদ্রেশ্বরে এলেও পরে শ্রীরামপুরে চলে গিয়ে ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তারা সেখানে নতুন শহর গড়ে তোলে ৷ ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ডেনমার্ক সরকার শ্রীরামপুর শহরটি ইংরেজ কোম্পানিকে বিক্রয় করে দেয়। বিদেশিদের মধ্যে রিষড়ায় গ্রীক ও কোন্নগরে আর্মেনীয় বণিকদের উপস্থিতির কথা জানা যায় ৷
বঙ্গদেশের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ জেলা হিসাবে হুগলির খ্যাতি বহু প্রাচীন । জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অজস্র ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান, দর্শনীয় ও ধর্মীয় প্রাচীন সৌধ। জেলার পথে ঘাটে ঘুরে মানুষের সাথে মিশে লেখক ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধান করেছেন। ঐতিহাসিক বিভিন্ন তত্ত্ব ও নথিভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে পরিচিত তথ্যগুলোকে ইতিহাসের সাথে সাহিত্য যোগ করে লেখক নতুন আঙ্গিকে দেখানোর প্রয়াস করেছেন। এতে ইতিহাস আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এই গ্রন্থে স্বল্প পরিসরের মধ্যে জেলার পরিচিতি, আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা, ঐতিহাসিক সরস্বতী নদী, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবনালেখ্য, স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান, মন্দির মসজিদ গীর্জার পুরাকীর্তিসম্বলিত দর্শনীয় স্থান, সাহিত্য-সংস্কৃতির কিছু পরিচয় তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটি সচেতন পাঠক ও গবেষক মহলে সমাদৃত হবে আশা করা যায়।
বই - হুগলি জেলা পরিচয়
লেখক-প্রসেনজিত দাস
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি