লাল-হলুদের ডায়েরি
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
একটা ফুটবল টিম। সেখানে যেমন ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা আছে, তেমনই রয়েছে ইংল্যান্ড থেকে ইরান, ঘানা থেকে নেপাল। সঙ্গে আবার পাকিস্তান, বার্মা বা এখনকার মায়ানমার।
এক অঙ্গে এত রূপ ইস্টবেঙ্গল ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে কী? এখনকার আইএসএলের জমানায় ব্যাপারটা অসম্ভব কিছু নয়। লেবানন, ফিজি সব দেশের ফুটবলারেরই রমরমা। বিশেষ করে নয়ের দশক থেকে কলকাতা তথা ভারতীয় ফুটবলের দখলদারি নিতে শুরু করেন বিদেশিরা।
এক সময়ে বিদেশি ফুটবলার খেলানো ছিল মোহনবাগানের নীতির সঙ্গে বেমানান। আজকের জমানায় সেই নীতি থাকলে কী হত, সেটা পাঠকদের নতুন করে বুঝিয়ে দিতে হবে না নিশ্চয়ই। সত্যি বলতে চিমা ওকোরি নামে এক নাইজিরীয় বুলডোজারকে আটকাবে বলেই বিদেশি নীতি ভাঙে মোহনবাগান। কিন্তু মজার হল, মোহনবাগানে খেলা প্রথম বিদেশির নামটাও চিমা ওকোরি!
ইস্টবেঙ্গলে বিদেশি ফুটবলারদের আনাগোনা স্বাধীনতার আগে থেকে। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। ভারত-পাকিস্তান এক সঙ্গে। বাংলাদেশ তো দূরের কথা। বার্মার ফ্রেড পুগসলে নামে এক ফুটবলার খেলতেন ইস্টবেঙ্গল। দেশভাগের পরেও এক ঝাঁক বিদেশি ফুটবলার খেলেছেন লাল-হলুদ জার্সি গায়ে চাপিয়ে। সে সময় তাঁদের দেশ ছিল পাকিস্তান। এঁদের মধ্যে বিশেষ ভাবে শোনা যায়, ফরোয়ার্ড মাসুদ ফকিরুর। তখনকার পাকিস্তানে জন্মানো তারাপদ রায় ইস্ট-মোহন দুই টিমে খেলেছেন। তেমনই আবার পাকিস্তান-জাত ইস্টবেঙ্গল ফুটবলার বলাই দে খেলেছেন ভারত-পাক দুই দেশের হয়েই।
এই সব ঘটনা স্বাধীনতার আগে বা স্বাধীনতার ঠিক পরের সময়ে তেমন অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু শুধু পাকিস্তান বা বাংলাদেশে আটকে ছিল না ইস্টবেঙ্গল। সেই আমলে হংকং থেকেই লাল-হলুদ জার্সি গায়ে চাপানোর নজির রয়েছে। ডেভিড উইলিয়ামস নামে এক নাইজিরীয় ফরোয়ার্ডও এসেছিল সাতের দশকের শেষে। যদিও আটের দশেকের শেষার্ধে চিমা ওকোরির ইস্টবেঙ্গলে আগমন ভারতীয় ফুটবলে এক নয়া যুগের সূচনা করল।
চিমাকে নিয়ে ইস্টবেঙ্গলে অসংখ্য গল্প, অসংখ্য মিথ চালু আছে। বলা যেতে পারে, ইস্টবেঙ্গল ও চিমার যুগলবন্দিতে এ দেশের ফুটবলে শুরু হল আফ্রিকান সাফারি। আফ্রিকা যে ভারতীয় ফুটবলের সাপ্লাই লাইন হতে পারে, সেটা সেই সময় থেকে শুরু হয়েছিল।
তার আগে অবশ্য ইস্টবেঙ্গলের বিদেশি বিপ্লবে এক চিরকালীন রূপকথার জন্ম নিয়ে ফেলেছিল। সৌজন্যে মজিদ বাস্কার। ইরানের বিশ্বকাপারকে নিয়ে আজও আহ্লাদে গদগদ হয়ে যান লাল-হলুদ জনতা। এই ক’ দিন আগে পর্যন্ত মজিদ যেন ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের এক ‘হারানো রূপকথা’। ভারত ছাড়ার পর দীর্ঘদিন তাঁর খোঁজ কেউ পাননি। সম্প্রতি অবশ্য তাঁর শুধু খোঁজই পাওয়া যায়নি, ভারতে এবং ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে পা পড়েছে মজিদের। লাল-হলুদ জনতার মধ্যে সেদিন একবারের জন্য তাঁধের বাদশাকে ছুঁয়ে দেখার পাগল আকুতি দেখেছিলাম! সে এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
চিমা যদি বুলডোজার ফুটবলের এক দৃষ্টান্ত হন, মজিদ তাহলে শিল্পের অন্য নাম। মাহমুদ খাবাজি, জামশিদ নাসিরিরাও তখন খেলতে এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গলে। কিন্তু কেউই মজিদ হয়ে লাল-হলুদ হৃদয়ের অন্তঃপুরের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হতে পারেননি। আর একটা ব্যাপারে দারুণ মিল ছিল চিমা আর মজিদের। দুজনেই কুখ্যাত বিতর্কের জন্য। চিমা মাঠে ঝামেলায় জড়াতেন। মারপিট, লাল কার্ড ইত্যাদি ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক। মজিদের ছিল বোহেমিয়ান জীবন। মাঠের বাইরেও তিনি যেন রাজা!
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.