মেজোবাবু আসবেন ও অন্যান্য

(0 পর্যালোচনা)
লিখেছেন/সম্পাদনা করেছেন
অর্ণব রায়
প্রকাশক সৃষ্টিসুখ

মূল্য
₹99.00
পরিমাণ
মোট দাম
শেয়ার করুন

মেজোবাবু আসবেন ও অন্যান্য 

অর্ণব রায় 

প্রচ্ছদশিল্পী -  পার্থপ্রতিম দাস 

এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার অর্ণব রায়ের গল্প সংকলন 'মেজোবাবু আসবেন ও অন্যান্য'  বইটিতে মোট ১৪টি ছোটগল্পের প্রায় সবগুলিই প্রকাশিত হয়েছে ভাষাবন্ধন, গল্পচক্র, খোঁজ, কালি ও কলম প্রভৃতি পত্রিকায়। 

'মোনাজাত' গল্পের অংশবিশেষ ------

মাতালের কাণ্ড, পাগলের খেয়াল, বজ্জাত ছেলেপিলের বাঁদরামি— সবরকম ভাবা হয়ে গেলে বোঝা গেল আওয়াজটা আসলে কান্নার। কেউ গলা ফাটিয়ে তারস্বরে সুর করে করে কাঁদছে। পুরুষের গলা। কতকটা বাঁধপুল বাজারের কাদেরের মতো শুনতে।

এশার নামাজের পর থেকেই আওয়াজটা সকলের কানে আসতে থাকে। প্রথম প্রথম যেমন হয়, কে না কে কাঁদছে মনে করে কেউ সে রকম পাত্তা দেয়নি। খুব জোরও ছিল না আওয়াজে। ঈদ গেছে কদিন আগেই। রোজই কেউ না কেউ বাড়ি ছেড়ে কাজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। দুর্গাপুর-আসানসোল-ধানবাদ থেকে শুরু করে দিল্লি-মুম্বাই-চেন্নাই কোথায় না কোথায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতে চলে যায় সব। বাড়ির মরদ কি বেটাটা বছরভরের জন্য চলে যাওয়ায় রোজই নানা বাড়ি থেকে মেয়েছেলেদের ফোঁপানোর আওয়াজ পাওয়া যায়। কখনও কখনও তা শুধু ফোঁপানিতে থেমে থাকে না। তাছাড়া দুমাস পরে বকরি ঈদ। অনেক কমবয়সি ছেলেপিলে, যারা বহুদূরে লেবার কি মিস্ত্রির কাজ করতে গেছিল, তারাও তো দুমাসের ব্যাপার বলে বাড়িতেই থেকে গেছে। তারাও অনেক সময় দলবেঁধে নানারকম খচরামি করে থাকে। মারপিট খুন-খারাপিও বাড়ে। বয়সের জোশ। তাছাড়া কাঁচা পয়সা।

এমনিতে সন্ধে হলেই সবাই আজকাল টিভির মধ্যে ঢুকে পড়ে। নেই নেই করে গাঁয়ের অনেক বাড়িতেই আজকাল ছোট বড় রঙিন টিভি। যাদের নেই, তারা বড় রাস্তার ধারে ধারে যে সব চায়ের দোকানগুলো গজিয়ে উঠেছে, সেগুলোতে গিয়ে ভিড় জমায়। কেবল টিভির দৌলতে রোজই মিঠুন কি বচ্চনের সিনেমা চলে কোনও না কোনও চ্যানেলে। ব্যস, সব সেঁটে থাকে একেবারে। কিন্তু শুধু বসে থাকলে চলবে না। চা বলো, লেড়ো বলো, আধ পাউন্ডের পাউরুটি বলো— সব ধাঁ ধাঁ করে উড়ে যেতে থাকে। মিঠুনের নাচ বচ্চনের মারপিটের সঙ্গে কখন যে তিরিশ চল্লিশ টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে আর রাত গড়িয়ে গেছে এগারোটার দিকে, খেয়ালই পড়ে না।

আশরাফুল হাজির বাড়িতে শুধু টিভির পাট নেই। কিনতে পারেন, কেনেন না। একটা আদ্যিকালের রেডিও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুড়ো ঘষঘষে আওয়াজে কী যে শোনেন! তাঁর কানেই প্রথম আওয়াজটা যায়। দুই ছেলে সারাদিন মুনিষদের সঙ্গে ভূতের মতো খেটে এখন তারাপদর চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গেছে। হাজিসাহেব রেডিও বন্ধ করে কান পাতেন। বেশ স্পষ্ট কান্নার আওয়াজ। সবল পুরুষ গলার বিলাপ। বড় পোতা বারান্দায় বসে পড়ছিল। তাকে ডাকেন। সামনে মাধ্যমিক। সে বিরক্ত হয়। তা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে লাঠি ঠুক ঠুক করে টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাড়ির মেয়েরা ছুটে আসে— “কুথাকে যেছেন জী?”

“দেখি আসি কে কাঁদতেছে?”

বাড়ির বাইরে বেরিয়ে মনে হল, আওয়াজ পশ্চিম দিক থেকে আসছে। কেউ কী এন্তেকাল করল? কিন্তু তা হলে তো মসজিদে আগে খবর যাবে। মসজিদে খবর গেলে কেউ না কেউ তাকে এত্তেলা করবেই। মাস ছয়েক হল বড় ইমাম সাহেব গত হয়েছেন। সেই থেকে মসজিদে কোনও ইমাম নেই। মোয়াজ্জেম আয়নুলই ঝাঁটপাট দেওয়া থেকে শুরু করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ানো, সব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঈদে শবেবরাতে কি কারও এন্তেকাল হলে সেই হায়দারপুর থেকে ইমাম এনে তবে গোর আজাবের কাজ কী ঈদগাহ-র নামাজ আদায় সব করতে হয়। সত্যি বলতে কী, গাঁ-দেশে মরদ আর কই! সব তো বাইরে। খেতের কাজে মুনিষ পাওয়া যায় না। যে কটাকে পাওয়া যায়, রোজ-মুজুরির বহর শুনলে মনে হয় কেয়ামতের দিন বুঝি এসেই গেল। ধান লাগানোর সময় কি ধান কাটার সময় বর্ডার পার করে বাংলাদেশ থেকে কিছু লোকজন মুনিষ খাটতে আসে। কিন্তু তাদের তো আর সারা বছর পাওয়া যায় না!

এসব ভাবতে ভাবতে হাজিসাহেব মসজিদের দিকেই যাচ্ছিলেন। রাস্তাতে আয়নুলের সঙ্গে দেখা। এদিকে কান্নার বিরাম নেই।

“কাঁদতেছে কে হে আয়নুল?”

“হামিও বুঝত্যাছি না জী। চলেন একবার গিয়ে দেখে আসি।”

রাস্তায় আরও কিছু লোক জুটে যায়। তারাও কান্নার আওয়াজ শুনেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। কান পেতে পেতে এগিয়ে গিয়ে জগন্নাথ সাহার পোড়ো বাড়িটার পেছনে যে বিরাট চাষ না দেওয়া মাঠ, সেখানে লোকটাকে দেখা যায়। দেখা যায় বলা ঠিক না। একে রাত, তায় শুক্লপক্ষ হলেও আকাশে মেঘ। দুপুর থেকে দফায় দফায় বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন গুমোট করে আছে। মাঠের মাঝামাঝি পোঁটলা মতন কালো কী একটা পড়ে আছে। নড়াচড়া করছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আওয়াজটা সেখান  থেকেই আসছে।

কান্না। টানা টানা। জড়ানো। সুর করে। মাঝে মাঝে কিছু কথাও আছে। ঝিঁঝিঁর ডাক, ব্যাঙের ডাক ছাপিয়ে এই তীব্র বিলাপে, যারা এসেছিল, তারা খানিক থমকে যায়। গোরাই প্রথমে টর্চ মারে। পুরুষ মানুষই বটে। পুরোদস্তুর জামাপ্যান্ট পরা। কাদায় মাখামাখি। হাঁটু গেড়ে সেজদা করার ভঙ্গিতে বসে। পিঠ ঝুঁকে আছে। মুখ মাটিতে প্রায় সাঁটানো। ওই অবস্থায় অমানুষিক জোরে কাঁদছে।

প্রথমে কিছু বোঝা না গেলেও, একটু ধাতস্থ হলে বোঝা গেল, কান্নার মধ্যে টুকরো টুকরো কথাও রয়েছে। মোয়াজ্জেম আয়নুল যে সুরে মসজিদের মাইকে আজান দেয়, প্রায় সেই সুরে একগাদা কান্না ঢেলে লোকটা যা বলে চলেছে তা জোড়া লাগালে খানিকটা এরকম দাঁড়াবে — “ইয়া আল্লা, তুমি হামার কথা শুনলা না, আলহামদোলিল্লাহ, কথা রাখলা না জী। দীন দুনিয়ার মালিক তুমি, দুনিয়ার কষ্ট বুঝলা না। আল্লা হামাকে ক্ষমা করলা না তুমি আমার গুনা, আল্লাআআআ...”

ভাদ্রের গুমোট সন্ধ্যা রাতের দিকে গড়াচ্ছে। অচেনা একটা লোকের প্রাণফাটা বিলাপ ব্যাপার দেখতে আসা লোকগুলোকে থম মেরে দাঁড় করিয়ে রাখে। ভূষণ মাস্টারের ছেলে নীহার আর গাছ-কাটা তারেক প্রথম জলকাদা ভেঙে মাঠের মধ্যে নেমে পড়ে। দেখাদেখি আরও কয়েকটা জোয়ান ছেলে নামে।

এতগুলো লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার গায়ে টর্চ মারছে, “ও ভাই, কে আপনি, কী হয়াছে, কাঁদতেছেন কেনে?” এইসব বলে ডাকাডাকি করছে। লোকটার কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই! সে নিজের মনে তারস্বরে কেঁদে চলেছে। সকলে এগিয়ে গিয়ে তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু তার গায়ে হাত দিতে, কি জিজ্ঞাসা করতে, কি দুটো সান্ত্বনার কথা বলতে কারও সাহস হয় না। যেন শেতলাতলার ভর-ওঠা ষষ্ঠীকে দেখছে। তারা নিজেদের মধ্যে গুনগুন করে। এগিয়ে যায় না।

তারেকই পরে দাবি করে, এভাবে প্রায় দশ মিনিট কেটেছিল। কী তারও বেশি হতে পারে। লোকটার কান্নার বেগ কমে আসে। সে সেজদা থেকে রুকুর ভঙ্গিতে উঠে আসে। ওই অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ থাকে। কান্না সামলায়। কয়েকবার হেঁচকি তোলে। চোখ মোছে। নাকে টানে। খ্যা-থু করে থুতু ফেলে। তারপর ওই জলকাদা ভরা ধানের নাড়া উঠে থাকা মাঠের মধ্যে একেবারে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। নড়াচড়া বন্ধ।

এতক্ষণ যারা তাকে ঘিরে উজবুক বনে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা একেবারেই ভড়কে যায়। মরে-টরে গেল না কী? সারের দোকানদার বুলটন আস্তে আস্তে গিয়ে একটু নাড়া দেয়, “ও ভাই!”

তারপর আরও জোরে, “এ জী ভাই, শুনছেন?”

এবার প্রায় সবাই মিলে লোকটাকে ঝাঁকাতে শুরু করে। কেউ লাঠি দিয়ে খোঁচা মারে। মিনিট কয়েক এসব হজম করার পরে, যখন সবাই ভাবছে গাঁয়ের একমাত্র ভরসা নীলু কম্পাউন্ডারকে ডাকবে কিনা, লোকটা উঠে বসে। সকলের দিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকায়। একটাও কথা বলে না। খালি হাত দুটো জোড় করে সকলের দিকে একবার দেখায়। টর্চের আলোয় মুখের ভাব যেন— ‘হামাকে একটু একা থাকতে দেন।’ আবার ধপাস করে শুয়ে পড়ে। 

ইতিমধ্যে কখন যেন আশেপাশের বাড়ির মেয়েরা দাঁতে আঁচল চেপে আলের ধারে ধারে এসে জড়ো হয়েছে। যারা মাঠের মধ্যে জলকাদায় নেমেছিল, কিছুই জানতে না পেরে ফিরে আসে। যে যার বাড়ির মেয়েছেলেদের ধমক-ধামক দিতে দিতে বাড়ির রাস্তা ধরে। কারণ লোকটা সেই যে শুল, আর ওঠেনি। নড়াচড়াও করেনি।

“যত্তোসব পাগলাখ্যাঁচার কাণ্ড! কামকাজ নাই। সন্ধেরাতে ধুধু মাঠের মধ্যে বসে হাঁউমাউ কান্না জুড়েছে। আমরা যে অতগুলো লোক গেলাম, অত করে সাধাসাধি করলাম, তা গেরাহ্যিই নেই বাপু!” এই মর্মে নানারকম ভাষায় আগামী কয়েকদিন আশেপাশের সবকটা বাঁধানো বটতলায়, হাটে-মাঠে আলোচনা চলে। যাদের একেবারেই কোনও কাজকাম নাই আর যারা কোনও ব্যাপারে একবার মাথা ঘামিয়ে ফেললে তার আঁটি বের না করে ছাড়ে না, তারা অবধি হাজার চেষ্টা করেও জানতে পারেনি লোকটা কে। পরদিন অনেকেই বড়-বাইরে না সেরে ঝুঁঝকো ভোরে মাঠের ধারে গিয়ে হাজির হয়। দেখে সব ভোঁ-ভা। লোকটার চিহ্নমাত্র নেই।

পর্যালোচনা ও রেটিং

0 মোট 5.0 -এ
(0 পর্যালোচনা)
এই বইয়ের জন্য এখনও কোন পর্যালোচনা নেই

সংশ্লিষ্ট বই

বই সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা (0)

প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য

অন্যান্য প্রশ্নাবলী

কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি