বারুণীস্নান ও অন্যান্য গল্প

(0 পর্যালোচনা)

লিখেছেন:
অভিজিৎ সেন
প্রকাশক:
সুপ্রকাশ

দাম:
₹280.00

পরিমাণ:

মোট দাম:
শেয়ার করুন:

বারুণীস্নান ও অন্যান্য গল্প

অভিজিৎ সেন

প্রচ্ছদ : শুভশ্রী দাস

----------

‘পার-অপার’ গল্পের অংশ

আমাতি অর্জুনপুরার পুবের মাঠটা খাড়ি থেকে ধাপে ধাপে ওপর দিকে উঠে গেছে। এখানকার জমির বৈশিষ্ট্য এমনই। খাড়ির পাড় থেকে মাঠ যেখানে শুরু হয়েছে, সেখান থেকে প্রতিটা জমির খণ্ড তার আগের জমি থেকে এক বিঘৎ থেকে এক হাত উঁচু। এইভাবে জমি ধাপে ধাপে উঠে আমাতি-অর্জুনপুরার রাস্তাকে স্পর্শ করেছে। আমি দেখলাম সাইকেল আরোহী একজন মানুষ সেই রাস্তা থেকে মাঠের আলের রাস্তায় নামলো। খাড়ির এ-পারে আমি যেখানে বসে আছি সেখানে থেকে, না-হোক ষাট ডিগ্রি কৌণিক উচ্চতা থেকে লোকটি অতি দ্রুত নেমে আসছে। এই বৈশাখ মাসে আলের রাস্তা পরিষ্কার এবং সাইকেল চালাবার উপযোগী। অবশ্য গত মরশুমে ধান কেটে নিয়ে যাওয়া মাঠের আলের রাস্তাতেও সে নামছে সুবিধা মতো। এসব রাস্তায় চলতে হলে শুধু খেয়াল রাখতে হবে আলের বিচিত্র গতিমুখ এবং অবিশ্বাস্য রকমের বাঁককে। কিন্তু সাইকেল আরোহী এই পথে অভ্যস্ত। তীব্র গতিতে সে আলপথে নেমে আসছে প্যাডেলে প্রায় চাপ না দিয়েই। মাঝে মাঝে অবশ্য তাকে নামতে হচ্ছে এবং বার-দুয়েক, মনে হলো, সে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। কিন্তু না, সে-ও বোধহয় তার ভারসাম্য রাখার কসরত।

এইভাবে আমাতি-অর্জুনপুরার রাস্তা থেকে খাড়ি অবধি আসতে তার আট-দশ মিনিট মাত্র সময় লাগল। আমি মনে মনে হিসেব করলাম। আলপথে মোট রাস্তা সে পার করে এসেছে আঁকাবাঁকা অন্তত তিন থেকে চার কিলোমিটার। যে গতিতে সে নীচের দিকে নেমেছে, তাতে এমন হওয়াই সম্ভব। হিসাব

করে আমার দুশ্চিন্তাই বাড়লো। যদিও ওই আগন্তুক যে অবশ্যই ওই খেজুর গাছের সাঁকোর ওপর দিয়েই খাড়ি পার হবে, তার কোনো মানে নেই। যদি হয়-ও, এবং আমাকে অনুগ্রহ করে সাইকেলটা পার করে দেয়-ও, এই ষাট ডিগ্রি কৌণিক উচ্চতায় অন্তত তিন কিলোমিটার রাস্তা আমাকে উঠতে হবে। প্রবল শক্তিতে প্যাডেল করে অত্যন্ত ধীরে এগোতে হবে এবং সময় লাগবে অন্তত দেড় ঘন্টা!

ব্যাপারটা বুঝে খুব আতঙ্ক হলো আমার। আক্কেলও হলো। যদি পরিকল্পনাটা উল্টো দিক থেকে করতাম অর্থাৎ যদি বাসে নিমপুর এসে সাইকেল রাস্তায় নামিয়ে আমাতি অর্জুনপুরা আসতাম, তাহলে কত সুবিধা হতো! কিন্তু আক্কেল তো ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এখন তো খাড়ির পাশে বসে আছি আধ ঘন্টা ধরে। যথার্থই 'অপার হয়ে বসে আছি।' বেলা দ্রুত পড়ে আসছে। বাড়িতে বলে এসেছি, আজ ফেরার সম্ভাবনা কম। ব্যাপারটা যেন সেদিকেই গড়াচ্ছে।

লোকটি সাইকেল থেকে ওপারে নামলো। ধুতির খুঁট একটু উঁচু করে গুঁজে নিলো সে। পায়ের ক্যাম্বিশের পামশু খুলে একটা একটা করে এপারে ছুঁড়ে মারল। পাতলা গড়নের লোকটি সাইকেলের সিটের নিচের রডের মাঝামাঝি জায়গায় ডান হাত দিয়ে ধরে ঝুলিয়ে নিলো। তারপর এতটুকু ইতস্তত না করেই ওই খেজুর গাছের সাঁকো বেয়ে তরতর করে এগোতে লাগল। আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলেও সে কিন্তু নির্বিঘ্নে এপারে চলে এল।

আমি তাকে কিছু অনুরোধ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। তার চেহারায় সচ্ছল মধ্য-চাষির লক্ষণ। তাছাড়া ভীষণ ব্যস্ত মানুষ সে, এমনও মনে হলো। এপারে এসে কোনোদিকে না তাকিয়ে পামশু পায়ে গলিয়ে সাইকেলে উঠে বসল লোকটি। আমার দিকে একবার তাকিয়েছে কি তাকায়নি, খিরাইলের রাস্তায় সে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে দিলো।

এই প্রথম শহরে বড়ো হওয়ার কারণে আমার আফশোস হলো। আমার আর কিছু বলা হলো না। এ-ও এক শহুরে সংকোচ বোধ হয়। এমন একজন অচেনা মানুষকে তো আর অনুরোধ করা যায় না যে, আমার সাইকেলটা একটু ওপারে দিয়ে আসুন না, ভাই ! গ্রামাঞ্চলে যাতায়াতের যতটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে আমি এখন একটা কিংবা দুটো বাঁশ একত্র করে যে সাঁকো বাঁধা হয়, তার ডাইনে কিংবা বাঁয়ে যদি নড়বড়ে আর-একটা বাঁশের সাপোর্ট থাকে এবং সেহেতু যদি ভীষণ নড়বড়ে হয়, যদি আশঙ্কাজনকভাবে দোলও খায়, আমি ভারসাম্য রেখে একহাতে সাইকেল ঝুলিয়ে দিব্যি ওপারে চলে যেতে পারব। কিন্তু পাশে ধরার মতো কিছুই নেই, এমন একটা খেজুর গাছের ওপর দিয়ে আমি হাতে সাইকেল ঝুলিয়ে কীভাবে পার হবো! কখনও হয়? অতএব এই নির্জন খাড়ির ধারে আমি ‘অপার' হয়ে বসে রইলাম।

পারে যাওয়া বা পার হওয়া বড়ো সাধারণ ব্যাপার নয়। একটা সিগারেট ধরিয়ে দু-টান দেওয়ার পর একটা দার্শনিক ভাবালুতা আমার ভেতর জেগে উঠলো। সমুদ্র নয়, নদী নয়, কেবলমাত্র একটা সামান্য খাড়ি, যাতে জল দু-হাত গভীরও নয়। সেই খাড়ি আমি পার হতে পারছি না। সব পথের জন্যই একজন পথপ্রদর্শক লাগে। পারের জন্য একজন পারের কর্তা লাগে, তা সে পারাবারই হোক অথবা এই খাড়ি। আমার পারের কর্তার এখনও দেখা মেলেনি, তাই অপার হয়ে বসে আছি। পারের কর্তা চাই, পারের কড়িও তাঁকে গুনে দিতে হবে।

এই বইয়ের জন্য এখনও কোন পর্যালোচনা নেই

বই সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা (0)

প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য

অন্যান্য প্রশ্নাবলী

কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি

Boier Haat™   |   © All rights reserved 2024.