ইতি আর্যাবর্ত
শাশ্বত ঘোষ
“দুর্গের ইংরেজ শাসনের প্রথমবার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহ সিপাহী বিদ্রোহ। যার সূচনা হয় বাংলার ব্যারাকপুরে। কিন্তু ঐতিহাসিকরা বলেন প্রথম ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে সিপাহী দের আক্রোশ দেখা যায় ভেলোরে। ভেলোর দূর্গে জেহাদ ঘোষণা করে টিপু সুলতানের বংশধরের নেতৃত্ব ব্যারাকের বিদ্রোহী সেনারা। যদিও বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ সেনা সফল হয় তবুও এই জেহাদ কম্পানীকে বুঝিয়েছিল ভারতীয় দের মধ্যেও লড়ার ক্ষমতা আছে। তাকে গলা টিপে হত্যা করা যাবে না।
ইতি আর্যাবর্ত ইতিহাসের সেই চরিত্রগুলির গল্প শোনায় যারা ইতিহাসের নায়ক চরিত্রের প্রদীপতলে অন্ধকারে ঢাকা থেকে প্রদীপের শিখাকে জ্বালিয়ে রাখার কাজটা করে গেছে—নিঃশব্দে,নিঃস্বার্থে। যাদের উপস্থিতি বদলে দিয়েছে ইতিহাসের গতিপথ কিন্তু তারা উপস্থিত হতে পারেনি ইতিহাসের পাতায়। যারা না থাকলে হয়তো ইতিহাসটা অন্যভাবে লেখা হতো কিন্তু তাদের কথা ইতিহাসে লেখে না কেউ।
------------------------------
উত্তর দিকের দুর্গপ্রাকারের উপর জমায়েত হয়েছে ব্রিটিশ সৈন্যের দল। তাদের মুখমণ্ডলে খেলে যাচ্ছে একটা হিংস্র পৈশাচিক হাসি। প্রতিহিংসার। নরমেধ যজ্ঞের পরিসমাপ্তিতে এত অভিনব আয়োজন না হলে চলে নাকি!
একটা পাথরের স্তম্ভের সাথে আটকানো লৌহশৃঙ্খলে বাঁধা শাহজাদার দুই হাত। দুই চোখে তার ঠিক কি অনুভূতি ফুটে বেরোচ্ছে তা রাতের মশালের হলুদ আলোর রহস্যময় প্রলেপে সঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে মৃত্যুতে তাঁর ভয় নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর চোখের সামনে যে স্তূপটা সাজানো হয়েছে, তার বিভীষিকা তাঁর চেতনাকে কেমন যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে! এরা কি মানুষ না পশু? পশু নয়, পিশাচ নিশ্চয়ই। নাহলে এইভাবে?
শাহজাদার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় ওই স্তূপের উপরে। মশালের আলোয় দেখা যাচ্ছে এখন সেই স্তূপের উপর আনাগোনা শুরু হয়েছে মাছির। ধীরে ধীরে বাতাসকে ভারী করে তুলছে মাংসের পচনের তীব্র কটু গন্ধ। ওই স্তূপ অন্য কিছুর না – মানবদেহের – খন্ডবিখন্ড দেহাবশেষের!
প্রায় বিশজন সৈনিককে পাথরের পিচ্ছিল সোপান বেয়ে নির্দয়ভাবে মারতে মারতে তুলে আনে কিছু লালমুখো গোরা সৈন্য। এই সৈনিকদের মধ্যে তিনজনকে তো শাহজাদা চেনে! একজন গুলাম আলী আর বাকিরা ওর সহকারী। দুদিন আগেই তো ওরা এসেছিল, সাথে ছিল বিষ্ণু রাও… কিন্তু বিষ্ণু রাও কোথায়? তার তো আজকের মধ্যে ফিরে আসার কথা গুরামকোন্ডা থেকে। সে কি এখানকার বিপদসংকেত বুঝে পালাতে পেরেছে? মনে হয় ধরা পড়েনি ইংরেজদের হাতে।
একধাক্কায় ওদেরকে পাথরের চাতালে ফেলে দেয় ব্রিটিশ সৈন্যের দল। নির্বিকার এবং নির্দয় মুখে তাকিয়ে থাকেন তাদের দলনেতা – স্যার রোলো গিলেসপি, তারপর আঙুলের নিশানায় নির্দেশ দেন। চাবুকের হিলহিলে সর্পিল দেহ আছড়ে পড়ে ওই হতভাগ্যদের পিঠে। তাদের আর্তনাদে চোখ বন্ধ করে ফেলে শাহজাদা।
ব্রিটিশ সৈন্যের নির্দেশে ওরা এগিয়ে যায় ওই মরদেহের স্তূপের দিকে। তারপর হাত লাগিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে টেনে বের করে আনে এক সহযোদ্ধার শব! তারপর কাঁধে করে নিয়ে যায় দুর্গপ্রাকারের শেষ সীমানায় আর… আর প্রাচীরের ওপাশে ছুঁড়ে ফেলে সেই দেহ!
ঝপাং!
শব্দ উত্থিত হয় দুর্গের চারিপাশে বেষ্টনী দিয়ে থাকা বিশাল পরিখা থেকে আর একইসাথে শোনা যায় অপর এক জান্তব চিৎকার – এক নয়, অসংখ্য ক্ষুধার্ত জন্তুর ওই শবদেহকে মুহূর্তে টুকরো টুকরো করে ফেলার উল্লাস। ওই পরিখার জলে অপেক্ষমান তখন আরও সহস্রাধিক কুমির যাদের ভাগ্যে হয়ত একটুকরো নরমাংসও জোটেনি নিজের স্বজাতিদের সাথে লড়াই করে।
স্তূপের উচ্চতা কমতে শুরু করে। ওই হতভাগ্য সৈনিকের দল নিজেদের সহযোদ্ধাদের দেহাংশ তুলে দেয় হিংস্র কুমিরের মুখে। ধীরে ধীরে একসময় নিঃশেষিত হয় শেষ মাংসখণ্ডও। মাথা নিচু করে সারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিধ্বস্ত, আহত, লাঞ্ছিত সেনারা, অপেক্ষা করে ব্রিটিশ সেনানায়কের পরবর্তী নির্দেশের, অপেক্ষা করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে কারাগারের কোনো অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করার।
এতক্ষনে হাসি ফোটে রোলো গিলেসপির মুখে। তারপর ভেসে আসে বজ্রনির্ঘোষ – “দ্য রেবেলিয়ন শুড এন্ড হিয়ার রাইট অ্যাট দিস মোমেন্ট। আই ওয়ান্ট নো ট্রেস।”
এগিয়ে আসে ব্রিটিশ সৈন্যের দল একদিক থেকে বন্দুক উঁচিয়ে। এতক্ষনে মৃত্যুর বিভীষিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে পরাজিত সৈন্যদের মুখে। তারা বুঝতে পারে কি ঘটতে চলেছে। কাতরকণ্ঠে তারা চিৎকার করে শাহজাদার দিকে তাকিয়ে – “বাঁচান সুলতান সাহিব…বাঁচান আমাদের…”
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.