খুঁটতে খুঁটতে
লেখক : অন্বয় গুপ্ত
"বারাসত প্যারীচরণ সরকার স্কুলে পড়ার সময়ে একবার, মাত্র একবারই ল্যাট্রিনে গেছিলাম। সেই প্রথম, সেটাই শেষ! ভয়ংকর গরম পড়েছিল, তার উপর বহুক্ষণ ধরে বল পেটানোর পর আর সহ্য হয়নি- ছুটে ল্যাট্রিনে ঢুকতেই হ'ল। স্যর ততক্ষণে ক্লাসে ঢুকে গেছেন, মিনিট কুড়ি লেট হয়ে গেল আমার পৌঁছতে। ক্লাসটা ছিল কম্পিউটারের। ঢুকতে আর দেবেন না জানি, তবু একবার সেই প্রিভির প্যাসেজের চাইতেও সরু গলায় বলতে গেলাম, 'আসব স্যর?' মারকুট্টা স্যর তখন একগাল হেসে বললেন, 'পায়খানা কেমন হ'ল?' (তিনি কীভাবে জেনেছিলেন সেটা ভেবে তখন অবাক লাগলেও আন্দাজ করেছিলাম কেউ নিশ্চয়ই রোল কলের সময়ে বলেছিল যে ও পায়খানায় গেছে।) আমিও সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছিলাম, 'পুরো গলানো সোনা।' সেই শুনে ক্লাসসুদ্ধ সবার দাঁত বেরিয়ে গেছিল। কথাটা হিট হয়ে যায়।
স্কুল লাইফে হাগা নিয়ে প্রায় সবারই নানান অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেক হাগিয়ে বন্ধুদের দেখাও পাওয়া গেছে।
প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়ে অনেকেই মাঝেমধ্যে গাছ থেকে কাঁঠাল পড়ার মতো ছড়িয়ে ফেলত! তারা এতটাই ছোট যে একা একা বাথরুমে যাওয়ারও ক্ষমতা ছিল না। একমাত্র কেয়ারটেকার কাম মাসি রেডিই থাকতেন। মাঝেমধ্যে এমন দৃশ্যও দেখা যেত যে চারজন মতো বাচ্চাছেলেকে লাইন দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবাই শার্ট উঁচু করে তুলে ধরেছে, কোমরের নীচ থেকে আর কাপড় নেই, অথচ পায়ে জুতো আর মোজা! শালপাতা মুড়ে নেওয়ার মতো তাদের প্যান্টুলগুলো নিয়ে মাসি পেছনে পেছনে চলতেন। সেই শালপাতা থেকে পাতলা খিচুড়ীর হলদে ফোঁটা মাটিতে পড়তে পড়তে যেত। বাথরুম ছিল একটাই। বাচ্চারা ঐভাবেই পরপর লাইন দিয়ে দাঁড়াত। গল্প করত। মাসি তখন প্যান্টগুলো ধুতে ধুতে গজগজ করতেন। সময় হয়ে গেলেই দৌড়ে গং বেল বাজিয়ে আসতেন, আবার ছুটতেন ধুতে। স্কুলময় একটা মেটে আমাশা আমাশা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত। বাচ্চাগুলোর বাড়িতে খবর পাঠানো হত, সেদিনকার মতো তাদের ছুটি।
সেই সময়ে ল্যাট্রিনে যাওয়ার দরকার হ'লে বলতে হতো, 'আন্টি, আমার 'অ্যা' পেয়েছে। 'অ্যা' তে যাব।'
অ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা করে পেটে প্রেশার দেওয়া থেকে কথাটা এসেছিল কিনা কে জানে!
এই ল্যাট্রিন মনে করলেই দ্বৈপায়ন এর কথা মনে পড়ে। তখন অ্যাডমিশন টেস্ট দেওয়ার জন্য একটা কোচিং এ পড়ি। ২০০৩ সাল। বাদাম নামে একটা ছেলের (এখন সে যাদবপুরেই পড়ে) বিশাল বাড়ির ছাদের ঘরে স্যর একটা বিরাট ব্যাচ পড়াতেন। সে এক হট্টমেলা। ছাদেই একটা ছোট্ট গুমটিতে ল্যাট্রিন এর ব্যবস্থা ছিল।
দ্বৈপায়ন সেখানে পড়েছিল সাকুল্যে পাঁচ-সাত দিন মতো। কালো। আমাদের তুলনায় বয়েস বেশী মনে হত। বেশ বড়সড়ো গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। হাল্কা জন লেজেন্ড এর মতো দেখতে। বাবার বিরাট বেওসা।
প্রথমদিন গিয়েই ক্লাস থ্রি-র ঐ 'ধেড়ে' ছেলে বাচ্চাদের মতো 'বাড়ি যাব' শুরু করল। ঘ্যানঘ্যান, উশখুশ করা জুড়ে দিল। তাতে লাভ হ'ল না দেখে খানিক পরে বলল 'পাইখানা'য় যাব। ছাদের ঐ নোংরা সিমেন্ট আর ঝুলওয়ালা গুমটিতে পাঠানো হ'ল। 'এখানে করব না' বলে ঘরে ঢুকে আবার ঘ্যানঘ্যানানি শুরু হ'ল। পড়া মাথায় উঠল। বাদামের বাবা উঠে এসে বললেন- 'আমাদেরটায় যাবে? কমোড আছে, আয়না আছে।'
দ্বৈপায়ন হঠাৎ 'ন্নান্নানা' করতে করতে ছোঁ মেরে ব্যাগ তুলে নিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে চলে গেল। সবাই এতটাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যে বহুক্ষণ কেউ কথাই বলল না। ধাতস্থ হওয়ার পর স্যর চিন্তায় পড়লেন- পরের ছেলে, কোথায় বাড়ি ...কিছু একটা হয়ে গেলে কী কৈফিয়ত দেবেন। কয়েকটা ছেলে ছুটে গেল। কোন খোঁজ নেই। এখন ওর পায়খানা সত্যিই পায় না বাড়ি ভাগার অছিলা ভগবান জানেন!
পরদিন দ্বৈপায়ন এসে হাজির। স্যর ইচ্ছে করেই কথাটা পাড়লেন না। ওকে বশ করার অন্য উপায় ভাবা শুরু করলেন। মিনিট পনেরো কাটতেই দ্বৈপায়ন আবার 'পাইখানা' বলেই দে ছুট। স্যর চিৎকার করে উঠলেন- 'যাও ওকে ধরে আনো।' আমরা সবাই ছুটলাম। ছুট ছুট ছুট... দ্বৈপায়নের সঙ্গে আমরা পেরেই উঠলাম না। ও হাওয়া হয়ে গেল! ক্লান্ত হয়ে গেলাম। ঘোর কাটার পর দেখি এমন জায়গায় আমাদের এনে ফেলেছে যেখানে কস্মিনকালেও আগে যাইনি। জঙ্গলে ভর্তি, পুকুরের মধ্যে হোগলার মতো বড় বড় ঘাস। ভূতের মতন তিনটে লোক চাকু হাতে বসে আছে। আমাদের তখন বয়েস অতি অল্প, নিজেরাই ভয় পেয়ে বহুৎ অলি গলি সামলে খালি হাতে ফেরত এলাম। প্রায় একঘন্টা মতো লেগে গেল।
পরদিন আমার পড়তে যেতে একটু দেরিই হয়েছে, গলিতে ঢুকতেই দ্বৈপায়নের সঙ্গে মুখোমুখি কলিশন লেগে গেল। আমাকে জাপটে ধরে ও সাইডে ঠেলে দিয়েই ধাঁ হয়ে গেল! বুঝলাম ফের ও ভেগেছে। সঙ্গে সঙ্গে দেখি পেছন থেকে 'ধর ধর' বলে ছেলেরা ছুটে আসছে। আমিও ছুটলাম। বাদাম তখন বেশ স্টাইলিশ একটা সাইকেল কিনেছে। হিরোগিরি দেখানোর জন্য ও আরো দু'জনকে ক্যারি করতে গেল। ব্যাস্। ওরা স্লো হয়ে গেল। দ্বৈপায়ন তখন অনেক দূর। অনেক ছুটে আরো একটা জংলা জায়গায় গিয়ে ওকে একজন শেষে ল্যাং মেরে পেড়ে ফেলল। পুরো পুলিশি অভিযান।... আমরা সঙ্গে সঙ্গে ওকে ঘিরে ব্যারিকেড বানিয়ে ফেললাম। ফের পালানোর জন্য আমাদের সঙ্গে ও লড়তে গেল। কিল টিল খাওয়ার পর ও শেষ অস্ত্র হিসেবে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে সত্যিসত্যিই হেগে দিল।
আমরা ফাঁপড়ে পড়লাম। স্যর এর অর্ডার বলে কথা! তখন দু'জন ছেলে ঐ অবস্থাতেই ওর হাত রুমাল দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধল। ঐভাবেই ওকে হাঁটিয়ে ধরে আনা হ'ল। ওর গু-ভর্তি প্যান্ট থলথল করছে আর দ্বৈপায়ন হেঁড়ে গলায় ভ্যাঁভ্যাঁ করে কাঁদছে। সে কী দৃশ্য! সে কী গন্ধ! সেদিন ও ব্যাগ ফেলেই পালিয়েছিল। ওর বাবার দোকানে খবর পাঠানোর পর বাদামের বাড়ি থেকে ওকে ধুইয়ে বাবার হাতে তুলে দেওয়া হ'ল। পরপর তিনদিন পড়া পুরো নষ্ট। তারপর একদিন স্যর ওকে বেদম পিটলেন। ব্যাস! তারপর ওকে আর দেখিনি। ও কিন্তু প্যারীচরণ সরকার স্কুলের ছাত্র ছিল। সেখানেও দেখিনি। সেজন্যই এসব ভুলিনি।
ঐ ব্যাচেই আরেকটা ব্যাপার ছিল। বন্ধুকে হাগতে সাহায্য করার মধ্যে কেউ কেউ বীরত্ব খুঁজে পেত। বাদাম ছিল এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। প্রিন্স বলে একটা হ্যাবলা মতো আদুরে ছেলে ছিল (এখনও তাই আছে) ওরাও বিরাট বড়লোক। ছাদের ঐ গুমটিতে গিয়ে হাগার পার মেয়েদের সামনেই (অবশ্য ঐ ব্যাচ ছিল ক্লাস সিক্স অবধি) উলঙ্গ অবস্থায় ঘরে ঢুকে আসত।কাঁদো কাঁদো হয়ে বলত, 'স্যর, আমি একা ছুচু করতে পারি না'। স্যরের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেত। মহা ল্যাটায় পড়তেন। তখন হঠাৎ বাদাম বুক ঠুকে বলত- 'স্যর, আমি ছুঁচিয়ে দেব?' তাড়াতাড়ি ঝামেলা মেটানোর জন্য স্যরও বলতেন- 'দাও।' বাদাম সকলকে দেখিয়ে দেখিয়ে তাই ই করত। ঐ বয়সে অনেক ছেলেই ছোঁচাতে পারত না বা অনেকেই ছাদে বা ঘরে হেগে ফেলত। বাদাম অম্লান বদনে এগিয়ে গিয়ে সেসব মিটিয়ে দিত, ধুয়ে দিত। স্যর ওর খুব প্রশংসা করতেন। বলতেন মিশনের আদর্শ ছাত্র হবে বাদাম। আমরা হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। মনে মনে শপথ নিতাম পরের বার এমন কেস হ'লে আমরাই ছুচিয়ে দেব।...."
-----------হেগলেস : অন্বয় গুপ্ত।
ফেলে আসা স্কুল জীবন আর ছেলেবেলার এমনই মজার ১৩টি রম্যরচনা নিয়ে খসড়া প্রকাশিত অন্বয় গুপ্তের এই বই।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.