কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী
কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের পথপ্রবাহ আমাদের নদনদীর ধারার মতোই জটিল। মূল, শাখা, শাখার শাখা, একাধিক ঘরানা, ঘরানার স্রষ্টা, ধারক বাহক, গুরুপরম্পরা, রাগ, রাগরূপ, শ্রুতি, স্মৃতি, আরোহণ, অবরোহণ, বাদী, বিবাদী, সমবাদী, প্রভৃতি শব্দ সমন্বয়ে যে বিষয়কল্পনা, তা ভীতিপ্রদ মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু সংগীত তো মজলিশে পরিবেশনের মন-ভেজানো শিল্প। সেই মজলিশী মেজাজ যদি সংগীতের ইতিহাসে সঞ্চারিত করা যায় তাহলে নীরসও হতে পারে তুলনাহীন সরস। তত্ত্ব ও তথ্যে ভরপুর, কিন্তু মুচমুচে। শতাব্দীর সেরা শিল্পী ও শিল্পঘরানার ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য বলা হচ্ছে, এক ঘরানার সঙ্গে আর এক ঘরানার তুলনা করা হচ্ছে, রাগ-রাগিণীর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, সামান্য শ্রুতির পার্থক্যে কেমন করে রাগরূপ পাল্টাচ্ছে তাও দেখান হচ্ছে, অথচ সরসরচনার চেয়েও সুখপাঠ্য। সংগীত যাঁর বিষয় নয় তিনিও একবার শুরু। করলে আর ছাড়তে পারবেন না। এই অসাধারণ গুণ এল কোথা থেকে। এইটাই হল কুমারপ্রসাদের লেখার ঘরানা। পারিবারিক উত্তরাধিকার। নিজে নাম করা শিল্পী। বিশিষ্ট ঘরানার উত্তরাধিকারী। বহু ওস্তাদের গান সেই ছেলেবেলা থেকেই সামনে বসে শুনে আসছেন। আবার বিদগ্ধ পাঠক। আবার অসাধারণ গুরু। এই সব গুণাবলী একত্র হয়েছে এই পরিবেশনে। সংগীত সম্পর্কিত লেখাও সেই কারণে হয়ে উঠেছে সংগীতের মতোই মজলিশী। শক্ত কথা, কিন্তু সহজ করে বলা। মার্গসংগীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পীরা রাজানুকুল্যে সংগীত নিয়েই জীবন কাটাতে পারতেন। তাঁদের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য, ঘটনাবহুল। অনেকেই ছিলেন ভীষণ মেজাজী, একরোখা। সংগীতের পাশাপাশি তাঁদের জীবনকাহিনীও ছিল ভীষণ আকর্ষক। সেই সব কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়। জমে আছে গুরুকুলে। প্রবাদপ্রতিম গুরুদের প্রবীণ শিষ্যমণ্ডলীর স্মৃতিতে।
কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিজে ঘরানাদার সংগীতগুণী। তাঁর পিতা ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন মার্গসংগীতের সমঝদার সুখ্যাত সমালোচক ও লেখক। সেই সূত্রে কুমারপ্রসাদ লালিতই হয়েছেন সাংগীতিক পরিবেশে। নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও রসসমৃদ্ধ লেখনীর যোগে রচনা করেছেন এমন এক গ্রন্থ-যা একাধাে একাধারে ইতিহাস ও মার্গসংগীতের তথ্য সমৃদ্ধ আলোচনা।
--------------------------------------
আসল কথা হল আবহাওয়া, মেজাজ, আর সেই মেজাজ থেকেই উদ্ভব এক তৃতীয় ধরনের সমঝ্দারি বা সেই আবহাওয়ায় মিশে যাবার ক্ষমতা— কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী’ পড়ার পর যে-আনন্দ লাভ হয়, তার মধ্যে আছে এই উদার বিচক্ষণ সহৃদয়তা। শিল্প বুঝতে গেলে শিক্ষিত হতে হয়। কিন্তু শিল্প অনুভব করতে গেলে যে-শিক্ষা— তা ব্যক্তিবিশেষের সহজাত। গুরুমুখী শিক্ষা তাকে পরিমার্জনা করে। উন্নীত করে বিশেষ মাত্রায়।
এ সুযোগ যার জীবনে ঘটেনি, তার নিজেকে ব্যর্থ বা অপূর্ণ ভাববার কোনও কারণ নেই। কেননা এ-জগতের মহাসুর মহাছন্দ যে-রস বিকীর্ণ করে, তা কোনও বিশেষের জন্য নয়। যে তাকে চায়, সে পায়। যে বিশেষভাবে চায়, সে পায় বিশেষে। এ গ্রন্থের রসানুভবও সেই উদারতা থেকে নেমে আসে। ভারতীয় মার্গসংগীতে যে শিক্ষিত, তার কাছে এ গ্রন্থ উপাদেয়। যে তেমন শিক্ষিত নয়, কেবল অনুভবী মনের কাছে যে ধরে সকল সুরের আবেদন, তার কাছেও এ গ্রন্থ পরম স্বাদু। পাকা রাঁধুনি আহার্যের গন্ধে বলে দেয়, এতে ফোড়ন কী দেওয়া আছে। কিন্তু ফোড়ন না জানলেও ভোজন রসিকের রসনা অতৃপ্ত থাকে না। সর্বকালের সকল রসিকের জন্যই একথা প্রযোজ্য। এবং এ লক্ষণ সংযুক্ত বলেই ‘কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী’ চিরকালের পাঠকের চিত্ততৃপ্তিকর বই।
[সংক্ষেপিত]
‘আনন্দ’ পত্রিকা। ত্রৈমাসিক। জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৬, ষষ্ঠ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি