জাহাজ সবে কয়েক ঘণ্টা পাড়ি দিয়েছে। ধীরে ধীরে জাহাজ মহাসমুদ্রে প্রবেশ করছে। চারধারে শুধু জলের সীমানা। শেষমাথায় জল আর আকাশ এক হয়ে গেছে। সন্ধে অবধি দ্বিজেন্দ্র ডকে বসে রইল। চারপাশ অন্ধকার হবার পর সে জাহাজের ওপর থেকে নেমে এল।
সুসজ্জিত জাহাজ। দেখতেও চমৎকার। প্রায় হাজারজন যাত্রী যাবার ব্যবস্থা আছে। বিলেতের খুব নামকরা এক কোম্পানি জাহাজ নির্মাণ করেছে। পৃথিবীর সবক'টি সমুদ্রেই তাদের জাহাজ চলে। দেশে থাকতেই সে এদের সুনাম শুনেছে। ইদানীং বাঙালিদের মধ্যে দু-একজন জাহাজ ব্যবসায় নেমেছেন। তার মধ্যে প্রখ্যাত জোড়াসাঁকো পরিবারের জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শোনা যাচ্ছে। দ্বিজেন্দ্র এটা জানার পর খুশি হয়েছিল। বাঙালিরা যে নিশ্চেষ্ট নয়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রমাণ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ছোটভাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার কবিতা লিখে খ্যাতি কুড়োচ্ছেন। দ্বিজেন্দ্রও কবিতা, গান লিখতে চায়। তবে সে আগে বিলেত থেকে পড়াশুনা শেষ করবে। তারপর তা নতুন করে ভাববে। পড়ার জন্য সে বৃত্তি পেয়েছে। সাধ করে কি মাস্টারি ছেড়ে বিলেত যাচ্ছে! গত দু'বছর সে একটা প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ছিল। বিলেত যাবার জন্য তাকে তা ছাড়তে হয়েছে।
জাহাজের ভেতর সবাই মিলে গল্পগুজব করছে। কয়েকজন সাহেব বসে আছে। তারা জোরে জোরে কথা বলছিল। তাকে দেখে তারা চুপ করে গেল। দ্বিজেন্দ্রের হঠাৎ সেজদার একটা কথা মনে পড়ল। তাকে নাকি কে একজন বলেছে জাহাজে দ্বিজেন্দ্র একটি ভারতীয়, বাকিরা সবাই ইউরোপিয়ান। বিজেন্দ্রকে যদি সবাই মিলে জলে ফেলে দেয়! সেজদা অবশ্য নিজেই কথাটার গুরুত্ব দেননি। তবু তাকে সতর্ক থাকার জন্য বলেছেন। এমন ঘটনা কখনও যে ঘটেনি তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তার মনে হল, এখানে যারা সাহেব রয়েছে তারা সবাই না হলেও বেশিরভাগ তাদের নিচু নজরে দেখে। তাকে দেখে সাহেবদের চুপ করে যাওয়াই তার প্রমাণ ।
তবে সবাই যে একরকম নয় তাও একটু পরেই দ্বিজেন্দ্র বুঝতে পারল। একটা টেবিল থেকে হঠাৎ একটা সাহেব তার দিকে চেয়ে বলল, হ্যালো, ইয়াং ম্যান। এদিকে এসো।
দ্বিজেন্দ্র সপ্রতিভ হল। সে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। সাহেব বলল, আমি ডেভিড। তুমি তো ভারতীয়। নাম?
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। উনবিংশ শতাব্দীর এক বিষ্ময়কর প্রতিভা। কবি, গায়ক, গীতিকার, সুরকার ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রের জীবন নিয়েই গড়ে উঠেছে এই উপন্যাস। বিলেতবাস, প্রেমিকা ও বিচ্ছেদ- এর বিষয়, তেমনই কুসংস্কারগ্রস্ত দেশীয় সমাজের চোখরাঙানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী তেজদীপ্ত মানুষের কথাও এতে উপস্থিত। কৃষকদরদী এক রাজকর্মচারী লড়াই-এর কাহিনীর পাশাপাশি, সহধর্মিণীর মৃত্যুতে বিষাদাচ্ছন্ন অসহায় মানুষের যন্ত্রনাও উপন্যাসে গ্রথিত। বাংলা গানের অন্যতম যাদুকর, হাসির গানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, স্বদেশী গানে সিদ্ধহস্ত ও স্বদেশচেতনায় জারিত নাট্যরচনায় ব্রতী এক সাধকের নিরন্তর সংগ্রাম-এর ছত্রে ছত্রে। একদা অন্তরঙ্গ বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তীব্র সংঘাত, ঈর্ষা, রাগ, মানসিক দ্বিধা ও উত্তরণের মর্মস্পর্শী বিবরণও-এর অংশ ।
‘কুসুমের মধু’ এক মহৎ, সৃষ্টিশীল মানুষের জীবন-তৃষ্ণার উন্মোচনের কাহিনী।
দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস "কুসুমের মধু"
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.