একটি শিশিরবিন্দু
(বজবজ ও বাটানগর সংলগ্ন অঞ্চলের ছুঁয়ে দেখা গল্প-কথা-রাজনীতি-ইতিহাস)
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী
সুপ্রকাশ অঞ্চলচর্চা গ্রন্থমালা ৬
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
"ফিরে যাচ্ছে সে একদা এই ‘আঠেরো ভাটির দেশ’-এর পথ ধরে। রামায়ণের বালকাণ্ডে যা নাকি ‘রসাতল’। আজ এই ভীষণ একা সন্ধে ঢলে যাওয়া দিনে এইসব রাস্তাঘাট আর তার উপর দিয়ে ভেসে বা হেঁটে বেড়ানো ইতিহাসদের গুনগুনও যেন কোন রসাতল থেকে উঠে আসে শরীরে। দূরে টিমটিম করতে থাকে আধুনিক বহুতলের আলো। আর সেই আলো থেকে সরে আসতে আসতে সে ধরে নেয় রেললাইন পেরিয়ে লম্বা ঘাসে ভরে থাকা একটা মাঠের পাশের রাস্তা। স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোতে তার ছায়া তার থেকে লম্বা হয়ে ছড়িয়ে যায় আরও কয়েকগুণ। হলুদ আলো জ্বলতে দেখে একটা চায়ের দোকানে বসতে তার ইচ্ছা হয় খুব। দোকানি মহিলার বয়স ষাটের কোঠা ছাড়িয়েছে বলেই বোধহয় দেখে। কালো গার্ডার দিয়ে সহজ ভাবে ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে মোটা ঘোলাটে কাঁচের চশমার একটা দিক। পাশের নিচু ক্লাব ঘরের হইহুল্লোড় সরিয়ে রেখে বয়স্কার নজর পাশে বসিয়ে রাখা পৌত্রের রুলটানা খাতার দিকে। “আসলে পরীক্ষা তো কাল, তাই।” “বাড়িতে পড়ে না?” “বাড়ি তো ফাঁকা।” ফাঁকা উচ্চারণের সঙ্গেই নজর যায় বৃদ্ধার কপালের উপরের দিকে। ফাঁকা। মাটির ভাঁড় এগিয়ে দিয়ে নাতির দুটো বানান ঠিক করে দেন তিনি। তারপর বলেন, “আসলে বাপ-মা গেছে জোগাড়ের কাজে। কলকাতায়। কদিন কাজ হচ্ছে সারা রাত। মাঝে তো বন্ধ ছিল না কতদিন? ওই লকডাউন। এখন খুব কাজ হচ্ছে। কিন্তু ছেলেটা পরীক্ষাই তো দিতে পারল না কয়েকটা মাঝে।” “কেন? পারল না কেন?” “রায়পুর থেকে ফেরার পথে মোবাইলটা হারাল ব্যাটা আমার। এদিকে পড়া তো সব অনলাইন করে দিল। কী করে পারব বল ভাই আমরা?”
রসাতল! কথাটা আবার ফিরে এসে ধাক্কা দেয় মাথায়। ধাক্কা দেয় লাগাতার একটা হেঁটে আসার ছবি। উঠে যাওয়া পায়ের ছাল। রেললাইনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শরীর। আর কয়েকটা রুটি। শুধু খিদের জন্যই যাতায়াতের একটা ভূগোল আর মানচিত্র তৈরি হয় যেন।
পিছন ফিরে দেখলে, এই অঞ্চলের যাতায়াতের ছবিটাও স্পষ্ট হয় খানিক। সেইসময় যাতায়াত মানে তো, সব পদ্মা-গঙ্গার দেশেই যেমন হয়। নদী-নালা-খাল। যাতায়াতের জন্য পায়ে হাঁটা পথ অথবা নদীতে নৌকা বা পানসিই ভরসা তখনও। বড় রাস্তাও তো হাতে গোনা সেই সময় এই তল্লাটে নিশ্চয়ই। অন্তত রেনেল সাহেবের ম্যাপ তো বলছে তাই। ১৭৭৮। জেমস রেনেলের ‘এ ডেসক্রিপশন অফ দ্য রোডস্ ইন বেঙ্গল অ্যান্ড বিহার’ বইতে কলকাতার দক্ষিণ দিকে লম্বা বেরিয়ে যাওয়া একটা রাস্তার খোঁজ পাওয়া যায়। কলকাতা থেকে দক্ষিণে বজবজ ছুঁয়ে কুলপি অবধি নিয়ে যাচ্ছে সেই রাস্তা। ম্যাপে যদিও রাস্তার গায়ে কলকাতা, বজবজ আর কুলপি ছাড়া এই তল্লাটের আর কোনও গ্রামের নাম বড় অক্ষরে চোখে পড়ে না বিশেষ। ছোট অক্ষরে মায়াপুর বা ফলতার নাম উল্লেখযোগ্য ভাবে উপস্থিত অবশ্যই। যার থেকে মনে করা যেতেই পারে, চারপাশের বাকি এলাকার থেকে ইতিহাসগত ভাবে অবশ্যই এগিয়ে ছিল এই বজবজ এলাকাই।
১৭৯৪ সালে বজবজ দুর্গ যখন পাকাপাকি ভাবে ভেঙে ফেলা হয়, তখন কলকাতা থেকে বজবজ অবধি এই রাস্তাটাই বড় হয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে যায় আছিপুর অবধি। কলকাতা থেকে রাস্তা আছিপুর অবধি এগিয়ে যেতেই, এই পথ ধরে উড়িষ্যা যাওয়ার ব্যাপারে সুবিধা হয় অনেকটাই। তীর্থে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সাধু-সন্ন্যাসীরা বেছে নিতেন এই পথ। রাস্তা সোজা। আছিপুর অবধি পথ ধরে এসে নদী পার হয়েই হাওড়া। সেখান থেকে মেদিনীপুর হয়ে উড়িষ্যা। উড়িষ্যাবাসী লোকজনেরও যাতায়াত বাড়তে লাগল যোগাযোগ সহজ হওয়ার কারণে। ফলে কবে যেন দক্ষিণ বাংলার এই রাস্তার নামই হয়ে গেল ‘উড়িষ্যা ট্রাঙ্ক রোড’ বা ‘কটক রোড’।
এদিকে পলাশীর যুদ্ধের পর চব্বিশ পরগণার জমিদারি পেয়ে গেছে ততদিনে ইংরেজরা। তারও আগে কিনেছে কলকাতার জমিদারি। ফলে এই দক্ষিণ বাংলা জুড়ে তখন অবাধ গতিবিধি তাদের। কলকাতার কাছেই বজবজ। দিনে দিনে ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েই চলেছে এখানে। তৈরি হয়েছে বেশ বড় একটা সাহেবি হোটেল আর ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গও! এটাই পুরোনো ফোর্ট উইলিয়ম বলে পরিচিত হয় পরে। বজবজ ততদিনে বেশ একটা টুরিস্ট ডেস্টিনেশন! ইউরোপ থেকে আসা সাহেব-মেমরা জাহাজে করে বজবজে নামার পর কয়েকটা দিন গঙ্গা পাড়ের হাওয়া-বাতাসে শরীর-মন চাঙ্গা করে তারপর সড়ক পথে রওনা দিতেন কলকাতার দিকে। ডেনাগন কোম্পানি, ‘গুড ওল্ড ডেজ্ অফ অনারেবল জন কোম্পানি’ বইতে যার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে ‘মেসার্স ডেনাগন অ্যান্ড কোম্পানি’ বলে, তাদের একটা বড় দোতলা হোটেল ছিল নদীর একদম কাছেই। ছিল বগি গাড়ি, ডাক গাড়ি বা ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থাও।
শুধু তাই নয়, বজবজের শান্ত নিস্তরঙ্গ পরিবেশ উচ্চবিত্ত ইংরেজদের এতটাই পছন্দ ছিল যে, কেউ কেউ তো এখানে বসবাসও শুরু করেছিলেন কুঠি বা বাংলো বানিয়ে। এই প্রসঙ্গে ‘মেমোয়ার্স অফ উইলিয়াম হিকি’ বইতে পাওয়া যায় প্রিয় মানুষ হারাবার আপাত সাধারণ অথচ মনকেমন করে দেওয়ার মতো আখ্যান একটা। আখ্যান? সত্যি ঘটনাকে আখ্যান বলা যায় কি? বুঝতে পারা যায় না। হিকির লেখার মতো একলা একটা বাতাস আচমকা আরও খানিকটা একলা করে দিয়ে যায় শুধু কখনও কখনও অন্যমনস্ক কাউকে।"
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.