সেকালের সমাজচিত্র
দীনেন্দ্রকুমার রায়
সম্পাদনা : শতঞ্জীব রাহা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী
--------------
শ্রীপঞ্চমীর পল্লী
মধ্যাহ্নে পুরোহিত পূজা শেষ করিয়া নৈবেদ্য ও দক্ষিণা লইয়া প্রস্থান করিলেন। বাজার ভাঙিলে বেলা দুইটার পর দোকানদারেরা আসরে ফরাস বিছাইবার আয়োজন করিতে লাগিল। আজ সন্ধ্যাকালে পাঁচালি আরম্ভ হইবে। রাঢ় হইতে এই পাঁচালির দল বায়না করিয়া আনা হইয়াছে। পাঁচালি ভিন্ন দুই রাত্রি যাত্রারও ব্যবস্থা হইয়াছে, কিন্তু ভালো দল বায়না করিয়া আনিবার উপযুক্ত টাকা সংগৃহীত না হওয়ায় তিনক্রোশ দূরবর্তী রায়পুরের যাত্রার দল বায়না হইয়াছে। ইহারা পঞ্চাশ টাকা লইয়াই দুই রাত্রি গান করিবে। তবে পান তামাক ও জলখাবার স্বতন্ত্র পাইবে। এই যাত্রায় দলের সকলেই নিকটবর্তী গ্রামের লোক, তাহারা বাড়ি হইতে খাইয়া আসিয়া গান করিবে।
সন্ধ্যার পূর্বেই দলে দলে লোক পাঁচালি শুনিবার জন্য বাজারে সমবেত হইতে লাগিল। বাজারের মধ্যে একবিন্দু স্থান খালি পড়িয়া রহিল না। আসরের চারিদিকে কাতার দিয়া লোক দাঁড়াইয়া গিয়াছে, কেহ ছেলে কাঁধে লইয়া গান শুনিতে আসিয়াছে, পল্লীবালকগণ আসরের স্থানে-স্থানে দল বাঁধিয়া বসিয়া গণ্ডগোল করিতেছে। আসরের একপাশে ভদ্রলোকদের জন্য সংরক্ষিত কয়েকখানি বেঞ্চি পড়িয়া আছে, অনেকে তাহার উপর দণ্ডায়মান।
সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হইবার পূর্বেই ঝাড়, দেওয়ালগিরি, ল্যাম্প প্রভৃতি জ্বালিয়া দেওয়া হইল। অল্পকাল পরে পাঁচালি দলের গায়কেরা বাদ্যযন্ত্রাদিসহ আসরে প্রবেশ করিল। প্রথমে গৌরচন্দ্রিকায় কিছু সময় কাটিল, শ্রোতৃবৃন্দ অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল। অবশেষে প্রধান অধিকারী বলরাম দাস বাঙালির প্রিয় কবি দাশরথি রায়ের পাঁচালি আরম্ভ করিল।
পাঁচালির বিষয় শ্রীমতীর কলঙ্ক ভঞ্জন। সুকণ্ঠ গায়করা কখনও ছড়ায়, কখনও বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান করিয়া এই অমৃত-মধুর প্রেমগাথা কীর্তন করিতে লাগিল। দর্শকেরা স্থানকাল বিস্মৃত হইয়া ভাববিহ্বল হৃদয়ে তাহা শ্রবণ করিতে লাগিল, শুনিতে-শুনিতে কোনো কোনো ভাবুক ভক্তের নয়নকোণে অশ্রুসঞ্চার হইল। পল্লীরমণীবৃন্দ চিকের অন্তরালে বসিয়া একাগ্রচিত্তে পাঁচালি শুনিতে লাগিল। যে সকল রমণী ঘরে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে রাখিয়া দু দণ্ডের জন্য পাঁচালি শুনিতে আসিয়াছিল, তাহারাও উঠিতে পারিল না, তাহার শিশুপুত্র-কন্যার কথা ভুলিয়া গিয়া, সংসার বিস্মৃত হইয়া ভগবানের এই মধুর লীলাকীর্তন শুনিতে লাগিল।
ঘন্টার পর ঘন্টা ধরিয়া পাঁচালি চলিল। বাদ্যধ্বনিতে গ্রামের দূরতম প্রান্ত প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। রাত্রি ক্রমে গভীর হইল, ঝিল্লিধ্বনি থামিয়া গেল, শুক্ল পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদ আস্তগমন করিলেন, সমগ্র গ্রামখানি গাঢ় নৈশ অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হইল।
পথপ্রান্তবর্তী সহকার-শাখা হইতে আম্রমুকুলের সৌরভ হরণ করিয়া তুষার-শীতল নৈশ বায়ুপ্রবাহ এক-একবার হু হু করিয়া বহিয়া যাইতেছে, শিশিরবিন্দু বৃক্ষশাখা হইতে টুপটাপ করিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে, শিমুল-গাছের উচ্চ শাখা হইতে শিমুলফুল মধ্যে-মধ্যে ঝুপঝাপ শব্দে মাটিতে খসিয়া পড়িতেছে, এবং নক্ষত্রের দল দূর আকাশ হইতে নিদ্রালস স্তিমিত নেত্রে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্তব্ধ ধরণীর দিকে চাহিয়া আছে, এমন সময় গ্রামপ্রান্তবর্তী বাগানের অভ্যন্তরস্থিত বাঁশবনের সন্নিকটে সমবেত শৃগালের দল সমস্বরে রাত্রি দ্বিপ্রহর ঘোষণা করিল এবং তাহাদের ঐকতান বন্দনা হইতেই আর একদল শৃগাল আর একদিকে মহা উৎসাহে হুয়াধ্বনি আরম্ভ করিল। পথে জনমানবের সাড়া নেই, কেবল শৃগালের কণ্ঠস্বরে ক্রুদ্ধ হইয়া গৃহস্থের পাঁদাড় হইতে দুই একটি কুকুর চিৎকার করিতেছে। গ্রাম্য চৌকিদারের কণ্ঠও আজ নীরব,—সে তাহার প্রকাণ্ড লাল পাগড়ি মাথায় ও মুখে জড়াইয়া, তাহার পাঁচ হাত লম্বা তৈলপক্ক বাঁশের লাঠির উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া, তন্ময়চিত্তে পাঁচালি শুনিতেছে।
গায়কেরা তখনও মধুর কণ্ঠে গাইতেছিল—
ননদিনী বলো নগরে,
ডুবেছে রাই রাজনন্দিনী কৃষ্টকলঙ্ক-সাগরে।
কাজ কি গোকুল, কাজ কি গো কুল,
ব্রজকুল সব হউক প্রতিকূল,
আমি তো সঁপেছি গো কুল,
অকূল-কাণ্ডারীর করে।
কাজ কি বাস, কাজ কি বাসে,
কাজ কেবল সেই পীতবাসে,
সে থাকে যার হৃদয়-বাসে,
সে কি বাসে বাস করে?
— শুনিয়া কোনো কোনো শ্রোতা দক্ষিণ হস্ত উর্ধ্বে তুলিয়া, তর্জনী ঘুরাইয়া ভাব গদগদ কণ্ঠে উচ্চৈস্বরে বলিয়া উঠিল, 'সকলে কৃষ্ণানন্দে পূর্ণ করে একবার হরি বলো!'—শত শত কণ্ঠের হরিধ্বনিতে সমগ্র গ্রামখানি পুনঃ পুনঃ প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল।
প্রবেশ করুন বা রেজিস্টার করুনআপনার প্রশ্ন পাঠানোর জন্য
কেউ এখনো কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি
Boier Haat™ | © All rights reserved 2024.